গাজার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া মানবিক সহায়তাবাহী বহর গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা-তে ইসরায়েলি নৌবাহিনী অভিযান চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সেখানে থাকা কর্মীরা। তাদের দাবি, আন্তর্জাতিক জলসীমায় অবস্থান করার পরও ইসরায়েলি নৌবাহিনী ফ্লোটিলার একাধিক জাহাজে উঠে পড়ে এবং ইঞ্জিন বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। কর্মীদের ভাষ্যমতে, এটি সম্পূর্ণভাবে ‘অবৈধভাবে আটকানোর’ পন্থা।
ফ্লোটিলা জানায়, অভিযানের সময় বেশ কিছু জাহাজের ক্যামেরা অফলাইনে নেওয়া হয়, তবে অল্পসংখ্যক জাহাজের লাইভ স্ট্রিম সক্রিয় রয়েছে। ওইসব ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, জাহাজের ডেকে কর্মীরা লাইফ জ্যাকেট পরে জড়ো হচ্ছেন। কিছু কর্মী ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন, ইসরায়েলি বাহিনীর নির্দেশনা অমান্য করলে তাদের জাহাজ জব্দ করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
ফ্লোটিলা জানায়, ‘আলমা’ ও ‘সিরিয়াস’ নামের দুটি জাহাজ এরই মধ্যে ইসরায়েলি বাহিনী আইডিএফ দ্বারা আটক হয়েছে। ‘সিরিয়াস’-এর লাইভ স্ট্রিম বন্ধ হয়ে গেছে এবং জাহাজে থাকা কর্মীদের অবস্থান এখনো নিশ্চিত নয়।
ইসরায়েল সরকারের অবস্থান
ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা ফ্লোটিলার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এবং তাদের ‘একটি সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্র’ থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ত্রাণ পাঠাতে তারা বিকল্প স্থলপথ ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছে।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিওন সা’আর ফ্লোটিলাকে উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘এখনো দেরি হয়নি। তারা যেন ফিরে যায় এবং অন্য পথ ব্যবহার করে সাহায্য পাঠায়।’
ইসরায়েল সরকার দাবি করেছে, ফ্লোটিলার কিছু সদস্য হামাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যদিও এই দাবির পক্ষে কোনো শক্ত প্রমাণ প্রকাশ করা হয়নি। ফ্লোটিলা কর্মীরা এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং বলেন, এটি একটি বেসামরিক ও নিরস্ত্র মানবিক মিশন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ফ্লোটিলার প্রোফাইল
ফ্লোটিলাটি প্রায় ৫০টি নৌকা ও ৫০০ জন কর্মী নিয়ে গঠিত। এতে রয়েছেন সুইডিশ জলবায়ু আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থানবার্গ, নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি মান্ডলা ম্যান্ডেলা, এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্য। তাদের দাবি, তারা প্রতীকী পরিমাণ মানবিক সহায়তা গাজায় পৌঁছে দিতে চান, যাতে অবরুদ্ধ অঞ্চলে মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়।
ইতালি ও স্পেনসহ কয়েকটি ইউরোপীয় সরকার সংঘর্ষ এড়াতে ফ্লোটিলার কর্মীদের ফিরে যেতে অনুরোধ জানিয়েছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি বলেছেন, ফ্লোটিলার এমন পদক্ষেপ চলমান শান্তি আলোচনা এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবকে দুর্বল করতে পারে।
অন্যদিকে, স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেন, ‘এটি একটি মানবিক মিশন- যা ইসরায়েল সরকার যদি সাহায্যের অনুমতি দিত, তবে ঘটতো না।’
আন্তর্জাতিক আইনি প্রেক্ষাপট
জাতিসংঘের সমুদ্র আইন অনুযায়ী, প্রতিটি রাষ্ট্র তার উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত জলসীমার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। সাধারণভাবে, আন্তর্জাতিক জলসীমায় জাহাজ আটকানো আইনত নিষিদ্ধ, তবে সশস্ত্র সংঘাত একটি ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচিত হয়।
হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ যুবাল শ্যানি বলেন, ‘যদি গাজার ওপর ইসরায়েলের অবরোধকে বৈধ ও সামরিকভাবে ন্যায্য ধরা হয়, তবে তারা পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই ফ্লোটিলা আটকাতে পারে।’
তবে, অন্য আইন বিশেষজ্ঞ ওমর শাটজ – যিনি প্যারিসের সায়েন্সেস পো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান এবং অতীতে ইসরায়েলি সুপ্রিম কোর্টে ফ্লোটিলা মামলায় যুক্ত ছিলেন– তিনি বলেন, ‘যদিও অবরোধ বৈধ বলে ধরা হয়, তবুও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, উচ্চ সমুদ্র থেকে গাজায় মানবিক সহায়তার একটি পথ থাকা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি দখলদার শক্তি জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তবে আন্তর্জাতিক আইন কিছু শর্তে হলেও মানবিক সহায়তা পাঠানোর অধিকার দেয়।’
তিনি পরামর্শ দেন, ইসরায়েল চাইলেই জাহাজে উঠে তল্লাশি চালাতে পারে- যেমনটি স্থলপথে সহায়তাবাহী ট্রাকের ক্ষেত্রেও করে।