ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর, ২০২৫

যুক্তরাজ্যে আগ্রহ কমছে ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের কাছে বাংলা ভাষার

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২৫, ০১:০৮ এএম
ব্রিটেনে বাংলা বই-এর দোকান। ছবি- সংগৃহীত

বাংলা ভাষা যুক্তরাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থায় জিসিএসই পর্যায়ে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে বহু আগেই। কিন্তু এ ভাষাকে কেন্দ্র করে যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পরিচয় ও আত্মমর্যাদাবোধ- তা ক্রমশই ম্লান হয়ে আসছে ব্রিটেনে বেড়ে ওঠা ব্রিটিশ-বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মের মধ্যে। বাংলা ভাষায় পড়তে পারা, এমনকি লিখতে পারা শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমছে আশঙ্কাজনক হারে।

সম্প্রতি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অনুষদের এক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা এই বিপর্যয়কে ঘিরে গভীর এক বাস্তবতা উন্মোচন করেছে। সেখানে উঠে এসেছে- যুক্তরাজ্যের ভাষা শিক্ষাব্যবস্থায় যে কাঠামোগত বৈষম্য বিরাজ করছে, তার সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাংলা ভাষাসহ অন্যান্য কমিউনিটি ভাষার অস্তিত্বের ওপর।

কেমব্রিজের গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৬১৫টি সরকারি স্কুল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যেখানে ভাষা শিক্ষা ঐচ্ছিক রাখা হয়েছে, সেখানে সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীর গড় হার ২৯ শতাংশ। আর যেখানে ভাষা বাধ্যতামূলক, সেখানে এই হার মাত্র ২১.৩ শতাংশ।

শুধু তাই নয়, ‘আবশ্যিক ভাষা’ পাঠদান করা স্কুলগুলোতে ভাষা শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার ৮২.৬ শতাংশ, অথচ ‘ঐচ্ছিক ভাষা’ থাকা স্কুলগুলোতে সেই হার নেমে এসেছে মাত্র ৩১.৯ শতাংশে। এই ফারাক শুধু সংখ্যার নয়- এটি সমাজে শিক্ষাগত বৈষম্য ও শ্রেণিভেদকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে।

গবেষকরা বলছেন, ২০০৪ সালে ভাষা শিক্ষাকে জিসিএসই’র বাধ্যতামূলক তালিকা থেকে বাদ দেওয়া ছিল এক বড় ধাপ, যার প্রভাব পড়েছে নিম্নআয়ের ও সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের ওপর। তারা ভাষা শিক্ষায় অংশ নিতে পারছে না, ফলে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য হারাচ্ছে ব্রিটেনের শিক্ষাঙ্গন।

বাংলা ভাষা: টিকে থাকার লড়াই

ব্রিটেনে বসবাসরত প্রায় পাঁচ লাখ ব্রিটিশ-বাংলাদেশির জন্য বাংলা ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং আত্মপরিচয়ের অংশ। অথচ আজ সেই ভাষাই টিকে থাকার লড়াইয়ে লিপ্ত।

শিক্ষাবিদ ড. রেণু লুৎফা, যিনি ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন, তিনি জানান, ‘এক সময় বাংলা ভাষা শেখাতে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষক আনা হতো। এখন সেই দিন ইতিহাস। বর্তমানে যারা বাংলা ভাষা জিসিএসইতে নিচ্ছে, তারা মূলত অভিভাবকদের আগ্রহে নিচ্ছে। কারণ, বাংলা শিখে এখানে কাজের বাস্তব সুযোগ নেই। আর ফরাসি, জার্মান বা স্প্যানিশ শেখার মাধ্যমে ক্যারিয়ার বা উচ্চশিক্ষার বাস্তব সুবিধা পাওয়া যায়।’

তার কথায় স্পষ্ট- বাংলা ভাষা শেখার অনীহার পেছনে শুধু অভিভাবক বা শিক্ষার্থীর দায় নয়, রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক উদাসীনতাও।

উল্লেখ, ব্রিটিশ-বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা গত দুই দশকে জিসিএসই পরীক্ষায় শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ শিক্ষার্থীদের তুলনায় ভালো ফল করে আসছে। কিন্তু তারপরও কমিউনিটি ভাষা হিসেবে বাংলা তাদের স্কুলের পাঠ্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পায় না।

এ যেন শিক্ষাগত সাফল্যের পরেও নিজের শিকড় হারিয়ে ফেলার এক বেদনাদায়ক বাস্তবতা। যে ভাষা তাদের পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ- সেই ভাষাই শিক্ষার মূলধারায় প্রান্তিক।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক ড. কারেন ফোর্বস এ প্রেক্ষাপটে বলেন, ‘সব শিশুরই ভাষা শেখার সমান সুযোগ থাকা উচিত। ভাষাকে ঐচ্ছিক হিসেবে রাখলে তা কম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় এবং শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে যায়।’

তিনি মনে করেন, বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষার বিস্তৃত সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়বে, এবং জাতীয়ভাবে জিসিএসই ভাষার অংশগ্রহণও উন্নত হবে।

তার দৃঢ় আহ্বান- সব স্কুলে ভাষা শিক্ষাকে পুনরায় আবশ্যিক হিসেবে ফিরিয়ে আনা হোক।

সমাধানের পথে কী করণীয়?

বাংলা ভাষা হারালে হারিয়ে যাবে একটি প্রজন্মের আত্মপরিচয়, পারিবারিক উত্তরাধিকার এবং এক গৌরবময় ইতিহাসের সেতুবন্ধন।

সরকার, শিক্ষা বোর্ড, কমিউনিটি ও অভিভাবকদের সমন্বিত প্রয়াস ছাড়া এই সংকট কাটানো সম্ভব নয়। বাংলা ভাষাকে কেবল ঐচ্ছিক ‘কমিউনিটি ভাষা’ হিসেবে নয়, বরং মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় উপযুক্ত সম্মান ও গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

কারণ ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়- ভাষা আমাদের পরিচয়, ইতিহাস, এবং ভবিষ্যতের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যম।