একুশ বছর ধরে অবৈধভাবে পদ আঁকড়ে থাকা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দায়ের করেছেন আয়েতুল্লা খোমেনি নামের সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী। অভিযোগটি তদন্তের জন্য নথিভুক্ত করা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়, ১৯৯৭ সালের ২২ ডিসেম্বর জারি করা অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের তপশিল অনুযায়ী শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা কোনোটিই সিরাজুল ইসলামের না থাকার পরও তিনি স্থপতি পদে অবৈধভাবে নিয়োগ পান বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
তপশিলে বলা হয়, এই পদের জন্য কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্য বিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হবে। কোনো সরকারি-বেসরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে নগর স্থাপত্যবিষয়ক কাজে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অগ্রাধিকার দেওয়া হবে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনায়। অথচ সিরাজুল ইসলাম রাশিয়া খরকোভ ইনস্টিটিউট থেকে স্থাপত্য বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন, যা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন নেই। এই ডিগ্রি স্থাপত্য বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি হিসেবে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েও স্বীকৃত নয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, বৈদেশিক ডিগ্রিধারী কাউকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ-পদোন্নতির ক্ষেত্রে তার ডিগ্রির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশি শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সাপেক্ষে রূপান্তর ও যথাযথ অনুমোদন গ্রহণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এই কর্মকর্তাকে স্থগিত পদের বিপরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে তা অনুসৃত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে তিনি রাশিয়ার যে ইনস্টিটিউট থেকে স্থপতি বিষয়ে ডিপ্লোমা অর্জন করেন, তা কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি হিসেবে বিবেচিত নয়। এ ছাড়া তিনি কোনো সরকারি-বেসরকারি অথবা আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে নগর স্থাপত্যবিষয়ক কাজেও কখনো নিয়োজিত ছিলেন না। ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জনের তিন বছর পাঁচ মাস একুশ দিন পর তিনি স্থপতি পদে নিয়োগ পান। তাই তার পাঁচ বছর অভিজ্ঞতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ।
শুধু তাই নয়, বিধিবিধান ও নিয়োগ তপশিল লঙ্ঘন করে এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা অতিরিক্ত ও চলতি দায়িত্ব প্রদানের নীতিমালা অগ্রাহ্য করে ২০০৪ সালের ১৮ অক্টোবর সাময়িকভাবে দায়িত্ব পালনের এক অবৈধ অফিস আদেশে নগর পরিকল্পনাবিদ পদটি তিনি দখলে নেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ২১ বছর ধরে অতিরিক্ত দায়িত্বের নামে প্রধান পরিকল্পনাবিদের পদটি তিনি আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। অথচ, ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কার্যক্রম শুরুর পর সেই আদেশটি অকার্যকর হয়ে যায়। তাই বর্তমানে ডিএসসিসির প্রধান পরিকল্পনাবিদ পদে দায়িত্ব পালনের সপক্ষে তার কোনো অফিস আদেশ নেই। একজন ডিপ্লোমা স্থপতি দীর্ঘকাল অবৈধভাবে প্রধান পরিকল্পনাবিদ থাকায় আধুনিক ঢাকা বিনির্মাণ ও পরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে না। নগরীর পার্ক, খেলার মাঠ, রাস্তাঘাট, ফুটপাত, হাটবাজার, শপিংমল, কমিউনিটি সেন্টার- এক কথায় নগরীর সামগ্রিক অবকাঠামোর কোনো কিছুই পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে না বলে অভিযোগপত্রে দাবি করা হয়। ফলে নগরবাসী নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, নগরে তীব্র যানজটে লক্ষ শ্রমঘণ্টা নষ্টের কারণে বছরে প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়ে থাকে। এদিকে এই অভিযোগপত্রের সপক্ষে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার কাটিং জমা দেওয়া হয়।
‘২১ বছর ধরে প্রধান পরিকল্পনাবিদ সিরাজ’ শিরোনামে গত ২৬ জানুয়ারি রূপালী বাংলাদেশে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে আওয়ামী মেয়র সাঈদ খোকন-তাপসের আশীর্বাদের পাশাপাশি স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও করা হয়। এ ছাড়া ওই প্রতিবেদনে বিভিন্ন সূত্রের বরাতে বলা হয়, পতিত আওয়ামী সরকারের আমলে সিরাজুল ইসলামকে একের পর এক তিন প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ব্যয়-বরাদ্দকৃত প্রকল্পগুলোতে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ থাকলেও তার টিকিটিও স্পর্শ করা যায়নি।
শুধু নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্প থেকেই ৩ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, বড় বড় সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সিরাজ নগর পরিকল্পনা বিভাগকে স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করেন। আশ্চর্যের বিষয়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও সিরাজ অধরা। তার বিরুদ্ধে একটি তদন্ত পর্যন্ত হয়নি। জানা গেছে, রূপালী বাংলাদেশের প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর তিনি আরও বেশি জেঁকে বসেছেন। কারণ, তার ব্যাংক হিসাবে রয়েছে অঢেল টাকা আর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক শক্তি। ডিএসসিসিতে বলাবলি হচ্ছে, আওয়ামীপন্থিদের পেছনে শক্ত প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জাতীয়তাবাদী ঘরানার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
অবশ্য পুরো বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে বলেছেন, কোনো কোনো মহল তাকে হেয় করার চেষ্টা করছে। এদিকে, দায়েরকৃত অভিযোগ সম্পর্কে ডিএসসিসির স্থপতি ও প্রধান পরিকল্পনাবিদ (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. সিরাজুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমি এখনো পর্যন্ত দুদক থেকে কোনো চিঠি পাইনি। তারা অনুসন্ধান করে দেখুক। তবে আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, চাকরি জীবনে কোনো অন্যায় করিনি। সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। কোনো মহল হয়তো আমাকে হেয় করার জন্য এসব অভিযোগ করেছে।