জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের নেতৃত্বে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে ভিন্নমত ও ক্ষমতার বৈষম্যের অভিযোগ তুলে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) থেকে পদত্যাগ করা নেতাদের নেতৃত্বে আসছে নতুন এই দলটি। বর্তমানে এনসিপিতে রয়েছেন এমন একটি অংশও পদত্যাগ করে যুক্ত হতে পারে নতুন এই দলে। পাশাপাশি বিগত ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র আলোচিত প্রার্থী, বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের নেতা, সাংবাদিক এবং সুধীজনেরাও যুক্ত হতে পারেন এই সংগঠনে। এ ছাড়া বর্তমান সরকারে যুক্ত আছেন এমন এক বা একাধিক ব্যক্তিরও নতুন দলে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যে দলটির নেতৃত্ব, রাজনৈতিক পন্থা, রূপরেখা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে নতুন দল গঠনের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা কেউ প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চাননি।
এদিকে গত এক বছরে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় আত্মপ্রকাশ করেছে দুই ডজনের বেশি রাজনৈতিক দল। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের রাজনৈতিক দল এনসিপি। অভ্যুত্থানের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি দলটি আত্মপ্রকাশ করে। দেশে নতুন ধারার রাজনীতি চালুর অঙ্গীকার করেছিলেন দলটির নেতারা। তবে আট মাস পরে দলটি এখন কোথায় দাঁড়িয়ে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে। তবে দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তরুণদের এই দলটির অন্তর্দ্বন্দ্ব-মতবিরোধ সামনে আসতে থাকে। জন্ম দেয় নানা বিতর্ক। নীতি ও আদর্শের ভিন্নমত এবং ক্ষমতার বৈষম্যের অভিযোগ তুলে ইতিমধ্যে দল ছেড়েছেন যুগ্ম আহ্বায়ক অনিক রায়, উত্তরাঞ্চলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক অলিক মৃ, যুগ্ম সদস্যসচিব তুহিন খানসহ বেশ কয়েকজন নেতা। দল ছাড়ার অপেক্ষায় আছেন আরও কিছু শীর্ষ নেতা। এনসিপির দুই শীর্ষ নেতাও দলের ভেতরের মতবিরোধের বিষয়টি স্বীকার করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, দলের মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থ, অনেক সময় দলের স্বার্থের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগত অর্জনের জায়গাটা অনেকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, দলের লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে না। এ কারণেই অনেকে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। যার চূড়ান্ত রূপ হিসেবে মতবিরোধ ও ফাটল। এক নেতা বলেন, ‘যে স্বপ্ন দেখিয়ে, যেভাবে আমাদের বলা হয়েছিল, তার প্রতিফলন পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্যই গ্রুপভিত্তিক অসন্তুষ্টি তৈরি হচ্ছে।’
এদিকে আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে কমিটি ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছে এনসিপি। দলীয় নিবন্ধনকে কেন্দ্র করে চলতি বছরের পহেলা জুন ঢাকা মহানগর উত্তরে সমন্বয় কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন শুরু হয়। এখন পর্যন্ত দেশের ৩৩টি জেলা ও প্রায় ২০০টি উপজেলায় সমন্বয় কমিটি করেছে দলটি।
নতুন দল এবং পদত্যাগের প্রশ্নে অলিক মৃ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘এনসিপি আসলে মধ্যপন্থি দল না হয়ে ধীরে ধীরে ডানপন্থি রাজনৈতিক অবস্থানের দিকে ঝুঁঁকছে’। অন্য নেতারাও কি এই উপলব্ধি থেকেই দল ছেড়েছেন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কে কোন কারণে পদত্যাগ করেছেন তা তারাই ভালো জানেন, এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’
প্রগতিশীল সংগঠন থেকে আসা এনসিপির বর্তমান ও সাবেক সমন্বয়কদের নিয়ে নতুন দল গঠনের বিষয়ে অলিক বলেন, ‘আমি শুনেছি যে নতুন দল তৈরির আলোচনা চলছে। তবে এ নিয়ে আমি এখনো কোনো প্রস্তাব পাইনি। যাব কি যাব না, সেটা ভবিষ্যতের বিষয়। তবে আলোচনায় যুক্ত হলে তখন বুঝতে পারব।’
এনসিপির সাবেক নেতা তুহিন খান তার পদত্যাগের সিদ্ধান্তকে ‘কিছুটা ব্যক্তিগত’ উল্লেখ করে বলেন, ‘এই মুহূর্তে রাজনীতি করা আমার জন্য খুব একটা উপযুক্ত নয়। তাই একটি বিরতি নিচ্ছি।’ এনসিপির রাজনৈতিক অবস্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এনসিপি ক্রমশ ডানপন্থি দলে পরিণত হচ্ছেÑ এটা বিভিন্ন জায়গায় তাদের অবস্থান ও বক্তব্য দেখলেই বোঝা যায়। আলাদা করে বলার কিছু নেই। তাদের রাজনীতির প্রভাব ও দিকনির্দেশনাও এখন অনেকটাই পরিষ্কার।’
নুতন দলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেকেই নানা ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক অ্যাকটিভিজম চালিয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে সেটা হয়তো কোনো প্ল্যাটফর্মে রূপ নিতে পারে, তবে এটা এখনই নিশ্চিত করে বলার সময় আসেনি’।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যারা বের হয়েছি, সবাই আপাতত কিছুটা সময় নিচ্ছি নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে। তাই এখনই কিছু ঘোষণা দেওয়া ঠিক হবে না।’
পদত্যাগী নেতারা এনসিপির ডানপন্থায় ঝুঁকে পড়ার যে ভাষ্য দিয়েছেন, সে বিষয়ে যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার বলেন, ‘এনসিপি ডানপন্থি দল হয়ে গেছে; এই কথাটা সঠিক নয়। আমাদের নিয়ে যে প্রচারণা হচ্ছে, অনেকে তাতে বিভ্রান্ত হয়েছেন বা হয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু এনসিপি সব সময়ই তার মধ্যপন্থা এবং নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যেই থেকেছে, এক মুহূর্তের জন্যও সেখান থেকে সরে যায়নি।’
কিছু আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া বা বিভ্রান্তিকর প্রচারণা থাকা সত্ত্বেও এনসিপি তার রাজনৈতিক অবস্থান থেকে একচুলও সরে যায়নি বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘দল মধ্যপন্থি রাজনীতিতেই অটল’। বড় দলে কিছু মতপার্থক্য বা বিভ্রান্তি খুব স্বাভাবিক মন্তব্য করে তিনি বলেন, অনেকেরই বড় রাজনীতি করার অভিজ্ঞতা থাকে না, আর রাজনীতি একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া; এখানে ধৈর্য লাগে। অনেকে আবেগপ্রবণ হয়ে ফেসবুকে কিছু লিখে ফেলেন, কিন্তু সেটা দলত্যাগের ইঙ্গিত নয়।’
যতজনের পদত্যাগের কথা শোনা যাচ্ছে, তাদের সংখ্যা খুব সীমিত উল্লেখ করে সরোয়ার তুষার আরও বলেন, ‘দু-একজন পদত্যাগপত্র দিয়েছেন বলে শুনেছি, তবে অনেকে কখনোই দলীয় কর্মকা-ে সক্রিয় ছিলেন না। এসব নিয়ে আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব কাজ করছেন, আলোচনাও চলছে। এখনো বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত নয়।
নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে দলটির যুগ্ম সদস্যসচিব সালেহ উদ্দিন সিফাত বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দলে অনেকে আসতে পারে, বের হতে পারে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। দলের মতাদর্শ কারো পছন্দ হলে আবার অন্য দল থেকেও আসে। তেমনিভাবে আমাদের সঙ্গে ছাত্রদল, শিবির এবং ইউনিয়নেরও অনেক ছাত্রনেতা যোগ দিয়েছেন। একই সাথে কেউ যদি মনে করেন দল থেকে পদত্যাগ করবেন, সেই স্বাধীনতা অবশ্যই আছে। এটা নিয়ে আমাদের আলাদা কেনো বক্তব্য নেই।’ কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বের হয়ে কেউ নতুন কোনো দল গঠন করছে কি না, সে বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই বা পাইনি। কেউ যদি বের হয়ে নতুন দল গঠন করতে চায় সেই স্বাধীনতাও সবারই রয়েছে।’