বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৫, ২০২৫, ১২:০৯ এএম

ঢাকার কেমিক্যালের গুদাম যেন মৃত্যুপুরী

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৫, ২০২৫, ১২:০৯ এএম

ঢাকার কেমিক্যালের গুদাম যেন মৃত্যুপুরী

** নিমতলীতে রাসায়নিক গুদামের আগুনে নিহত ১২৪ জন
** চুড়িহাট্টায় কেমিক্যাল গোডাউনের অগ্নিকাণ্ডের নিহত ৭১

রাজধানীর পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় কেমিক্যাল গোডাউনের অগ্নিকাণ্ডের ৭১ জন মারা যান। এই ট্র্যাজেডির প্রায় ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও মৃত্যুপুরী সেই এলাকা এখনো নিরাপদ নয় বলে সতর্ক করে আসছিলেন বিস্ফোরণ বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া আজ থেকে ১৬ বছর আগে ভয়াবহ নিমতলী ট্র্যাজেডির ঘটনা ঘটে। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে রাসায়নিক গুদাম থেকে সূত্রপাত হওয়া আগুনে পুড়ে মারা যান ১২৪ জন। আহত হন অনেক মানুষ। তখনো আমরা সতর্ক হইনি। এর মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুরের গার্মেন্টস কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিকা-ের ঘটনায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অন্তত ১৬ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে হতাহত হয়েছেন অনেক মানুষ।

৯ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে যোগ দেয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। কেমিক্যাল গোডাউন ও অগ্নিকা-ের ঘটনায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা এখন অগ্নি বোমার শহর। যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এখনো সতর্ক না হলে ঢাকার অলি-গলিতে আবার ঘটতে পারে এমন মৃত্যুপুরীর ঘটনা।

অবশ্য বিস্ফোরণ বিশেষজ্ঞ ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত সরকারের আমলে পুরো রাজধানীর মিরপুর ও উত্তরাসহ বেশকিছু এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছিল সিটি করপোরেশন। সেই অভিযান কিন্তু আমরা এই আমলে তেমনটা দেখিনি। কাজেই মিরপুর তো ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গোডাউনের তালিকায় ছিল। সরকারের উচিত ছিল আগে থেকে সতর্ক থাকার। তাহলে হয়তো নতুন করে এই ট্র্যাজেডির ঘটনা আমাদের দেখতে হতো না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ঢাকা শহর এখন এটম বোমার শহরের মতো। যেকোনো সময় পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে মানুষ। ঢাকার অলি-গলিতে যখন তখন ঘটছে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌহিদুল হক বলেন, ‘ঢাকার মানুষ বসবাস করছে এক হিসেবে এটম বোমার সঙ্গে। এসব কেমিক্যাল সরানোর পদক্ষেপ বারবার ব্যর্থ হয় আর বারবার শ্রমজীবীসহ আপনজনদের হারাতে হয়। তিনি বলেন, এখন মিরপুরের ঘটনাসহ অনেক কিছু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ঢাকা মৃত্যুপুরী হলেও কবে টনক নড়বে কর্তৃপক্ষের? সাধারণ মানুষের এমন আহাজারি, মৃত্যুযন্ত্রণা কি কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা দেখেন না? কেমিক্যালের গুদাম কেন সরছেই নাÑ এ প্রশ্নের উত্তর কি সাধারণ মানুষকে দেওয়ার মতো কেউ নেই?

সূত্র মতে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ২৭,৬২৪টি বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। এই ঘটনাগুলোতে ৭৯২ কোটি টাকার বেশি সম্পদের ক্ষতি হয় এবং ১০২ জন নিহত হন। ২০২৪ সালে সারা দেশে মোট ২৬,৬৫৯টি বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এসব আগুনে প্রাণ হারিয়েছেন ১৪০ জন, আহত হয়েছেন আরও ৩৪১ জন। এ ছাড়া ২০২৫ সালে প্রথম ৭ মাসে ১৫৪ জন আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় মারা গেছে। তবে একটি গোয়েন্দা তথ্য মতে, ২০২৫ সালে প্রায় ১ হাজার মানুষ বিভিন্ন সময় বিস্ফোরণে জীবন হারিয়েছেন। যদিও সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থা ২০২৫ সালের বিস্ফোণের সঠিক তথ্য জানাতে পারেননি।

এদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজধানীর পুরান ঢাকায় ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক পণ্যের গুদাম রয়েছে। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে খোদ বাসাবাড়িতেই। তা ছাড়া সারা ঢাকা শহরে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থা ৪৮৫০টিরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যার মধ্যে মিরপুর ও উত্তরা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরান ঢাকাসহ সারা ঢাকাতে প্রায় ৪,০০০ ব্যবসায়ী রাসায়নিক ব্যবসার সাথে জড়িত।

সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য মতে, কেমিক্যাল গোডাউন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে দুর্ঘটনা এড়াতে হাতে নেওয়া হয়েছিল অনেক পদক্ষেপ। কিন্তু আলোর মুখ দেখেনি সেগুলো। এ ছাড়া সেই সময় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরে। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হলেও দীর্ঘমেয়াদিগুলোর বাস্তবায়ন নেই।

জানা গেছে, শুধু পুরান ঢাকায় ছোট-বড় সব মিলিয়ে ২৫ হাজার কেমিক্যাল গুদাম রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকিগুলো অবৈধ। বিগত সরকারের সময়ে দুবারই সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বলা হয়েছিল, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পুরান ঢাকা থেকে দাহ্য রাসায়নিকের ব্যবসা স্থানান্তর করা হবে। তবুও পুরান ঢাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এসব কেমিক্যাল গুদাম কোথাও সরেনি।

এ ছাড়া চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পরে কয়েক দফা অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে পুরান ঢাকায়। দুর্ঘটনা হলেই রাসায়নিক কারখানা স্থানান্তরের বিষয়ে আলোচনা হয়, কয়েক দিন পর তা থেমে যায়। ২০১৯ সালে ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। পরে এফবিসিসিআইয়ের অনুরোধে ডিএসসিসি উচ্ছেদ অভিযান সাময়িক স্থগিত করে। এরপর আর অভিযান শুরু হয়নি।

এদিকে পুরান ঢাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, কেমিক্যালের দোকানগুলোতে সারি সারি প্লাস্টিকের ড্রাম আর দাহ্য রাসায়নিক পদার্থে ঠাসা। কোনো কোনোটিতে আবার বস্তাভর্তি দাহ্য কেমিক্যাল। তার ঠিক ওপরেই এলোমেলোভাবে ঝুলছে অসংখ্য বৈদ্যুতিক তার। দোকানের ওপরেই রয়েছে বাসাবাড়ি। পুরান ঢাকার আরমানিটোলা, লালবাগ, কোতোয়ালি, বংশাল, চকবাজারসহ বেশির ভাগ এলাকার কেমিক্যাল দোকানগুলোর এমন দৃশ্য চোখে পড়ে।

এ ছাড়া পুরান ঢাকার আবাসিক ভবনগুলোর নিচতলায় বেশির ভাগই বিভিন্ন কারখানা ও গোডাউন থাকে। এসব গোডাউনেই মজুত থাকে প্লাস্টিকের ড্রাম আর দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ। এসব গুদামে রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোইলসহ বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ যা আগুনের সংস্পর্শে এলে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।

২০১০ সালে নিমতলীতে অগ্নিকা-ের পর দুর্ঘটনা রোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ইকবাল খান চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি কেমিক্যাল গুদাম অপসারণসহ ১৭ দফা নির্দেশনা দেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই সুপারিশমালা দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে ফাইলবন্দি। এর মধ্যেই ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে নিমতলীর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চকবাজারের চুড়িহাট্টায়। এ সময়ও বেশকিছু সুপারিশ করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি। এতে আগুনের জন্য ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় গুদামজাত করা বিপুল পরিমাণ রাসায়নিককে দায়ি করা হয়।

চুড়িহাট্টায় অগ্নিকা-ের পর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। অগ্নিকা- প্রতিরোধে ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলোÑ অগ্নিকা- প্রতিরোধে আবাসিক এলাকায় যেকোনো ধরনের রাসায়নিকের দোকান বা গুদাম স্থাপন করা যাবে না। পুরান ঢাকার সব রাস্তা ও গলিপথ বাধামুক্ত করে কমপক্ষে ২০ ফুট প্রশস্ত করতে হবে। এসব রাস্তায় স্ট্রিট হাইড্রেন্ট স্থাপন করে নির্দিষ্ট দূরত্বে পানির প্রবাহ নিশ্চিত রাখতে হবে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের সেই সুপারিশের পুরোপুরি বাস্তবায়ন ঘটেনি আজও।

২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকা-ে নারী ও শিশুসহ ১২৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর পুরান ঢাকার অবৈধ রাসায়নিক দ্রব্যের দোকান অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং ২০১৫ সালে কেরানীগঞ্জের সোনাকান্দায় ২০ একর জমিতে কেমিক্যাল পল্লী গঠনের কথা থাকলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণে ওই জমি আইটি পার্ক করার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়।

এদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ আশিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা কোনো ঘটনার পরও সতর্ক হই না। সতর্ক না হওয়ার কারণে আবারও বিস্ফোরণ বা অগ্নিকা-ের ঘটনার শিকার হয়ে দিনের পর দিন আপনজনদের হারাচ্ছি। সবচেয়ে দুর্ভাগ্য আমাদের দেশে একটি ঘটনা ঘটার পরে মানুষ কিছুদিন সতর্ক থাকেন। পরে আর এসব ঘটনাকে কিছু মনে করেন না। আমরা নিমতলী, চুড়িহাট্টাসহ অনেক ঘটনাই ভুলে গিয়েছি। মিরপুরের রাসায়নিক বিস্ফোরণের ঘটনাও সতর্ক না হয়ে ভুলে যাব একদিন।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!