প্রতিদিনের মতোই গতকাল মঙ্গলবারও কাজে যান রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়ির আগুনে পুড়ে যাওয়া পোশাক কারখানার মেশিন অপারেটর নাজমুল ইসলাম। যথাসময়ে যোগ দিয়েছিলেন কাজে। কিন্তু বিধি বাম, কাজে যোগ দেওয়ার কিছুক্ষণ পরই পাশের কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লাগে। তাৎক্ষণিক নাজমুল স্ত্রীকে ফোন দিয়ে ‘আগুন, আগুন, বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে আর্তনাদ করতে থাকেন। কিন্তু এরপর থেকেই আর মিলছে না তার খোঁজ।
এদিন বেলা ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে শিয়ালবাড়ির একটি কেমিক্যাল গোডাউন ও একটি গার্মেন্টসে আগুন ধরে যায়। এ ঘটনায় নিখোঁজদের একজন নাজমুল ইসলাম।
জানা গেছে, আগুন লাগার পর স্ত্রীকে ফোন দিয়েছিলেন নাজমুল। মোবাইলের এ প্রান্ত থেকে শুধু বলেছেন, আগুন আগুন, বাঁচাও। তারপর লাইন কেটে যায়। তারপর থেকে নাজমুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
গতকাল সন্ধ্যায় নিখোঁজ নাজমুল ইসলামের স্ত্রী এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, ‘আমার সাথে কথা হওয়ার পর থেকে স্বামীর সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারতেসি না। ঢাকা মেডিকেল, ইবনে সিনা, ইসলামি মেডিকেলসহ আশপাশের সব হাসপাতালে গিয়া খোঁজ করসি। কোথাও পাইতেসি না। গার্মেন্টস মালিককে কল করছিলাম, তিনি বলছিল, কেউ মরে নাই; সবাই নিরাপদে আছে। কিন্তু আমি তো আমার স্বামীরে খুঁইজা পাইতেছি না।’
কান্না করতে করতে তিনি বারবার বলছিলেন, ‘ওই যে, যখন আগুন লাগে তখন ফোন দিয়া বলছিল তারে বাঁচাইতে। ওইটাই ছিল শেষ কথা। এরপর আর কোনো যোগাযোগ নাই।’
এদিকে আগুনের ঘটনায় অনেকের খোঁজ না মেলায় তাদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠে শিয়ালবাড়ি ও আশপাশের সড়ক। কেউ হাসপাতালে দৌড়াচ্ছেন, কেউ ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা ধরছেন।
মো. শফিকুল ইসলাম হাতে ভাগ্নি মাহিরার (১৪) ছবি নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন আগুনে পুড়ে যাওয়া ভবনের সামনে। চোখে মুখে অশ্রু আর আতঙ্ক।
তিনি বলেন, ‘আমার ভাগ্নি মাহিরা গার্মেন্টসের তৃতীয় তলায় কাজ করত। আগুন লাগার পর থেকে খুঁজতাছি। কোনো হাসপাতালেও পাই নাই। ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা কইসে ধৈর্য ধরতে।’
নিখোঁজ নারগিস আক্তারের বড় বোন লাইজু বেগম বলেন, ‘আমার বোন সকাল পৌনে ৮টায় কাজে আসে। সকাল ১১টার দিকে খবর পাই আগুন লাগছে। তার এক সহকর্মীর সঙ্গে কথা হইলে সে কইসে আগুন লাগার পর ভিতর থাইকা কেই বাইর হইতে পারে নাই। আমার বোনের কোনো খোঁজ পাইতাসি না।’
সরেজমিনে দেখা যায়, শিয়ালবাড়ির ৩ নম্বর সড়কের দক্ষিণ পাশে শাহ আলম কেমিক্যালের দুইতলা গুদামটি আগুনে সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। উপরের তলায় ছিল টিনের ছাউনি। আগুনের সূত্রপাত এই গুদাম থেকেই। বিস্ফোরণের পর মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের চারতলা পোশাক কারখানায়। দুই ভবনের মাঝখানে ছিল সরু একটি রাস্তা। ফলে ফায়ার সার্ভিসের আগুন নির্বাপণের কাজ ব্যাহত হয়।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে তারা আগুন লাগার খবর পেয়ে ১১টা ৫৬ মিনিটে তাদের প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। প্রাথমিকভাবে পাঁচটি ইউনিট কাজ শুরু করে; পরে আরও সাতটি ইউনিট যোগ দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হঠাৎ করে গার্মেন্টসে বিস্ফোরণ ঘটে, তারপর মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের কেমিক্যাল গুদামে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। পাশে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরাও আগুন নেভানোর কাজে অংশ নেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন