- কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের নির্দেশে হত্যাকা- ঘটিয়েছে তার অনুসারীরা, জানিয়েছে পুলিশ সূত্র
- ছোট সাজ্জাদ ও বাবলা একসঙ্গে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালালেও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিভক্ত হয়ে পড়েন
- সাজ্জাদের অনুসারী রায়হান গুলি করেছেন বলে অভিযোগ বাবলার বাবার
‘তোর সময় শেষ, যা খাওয়ার খেয়ে নে’Ñ তিন দিন আগে ফোনে এমনই হুমকি পেয়েছিলেন চট্টগ্রাম নগরের চালিতাতলী এলাকায় বিএনপি প্রার্থীর গণসংযোগের সময় প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত ‘সন্ত্রাসী’ সরোয়ার হোসেন ওরফে বাবলা। গত বুধবার রাতে বাবলার বাবা আবদুল কাদের সাংবাদিকদের কাছে এমনই অভিযোগ করেন। এ সময় তিনি চট্টগ্রামের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদের সেকেন্ড ইন কমান্ড রায়হান এই হুমকি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেন।
এদিকে সরোয়ার হোসেন বাবলা হত্যাকা-ের ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও এ ঘটনায় রাত ৮টা পর্যন্ত এই রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি নগর পুলিশ। মামলাও নথিভুক্ত হয়নি থানায়। কারা এবং কোন কারণে এই হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে, তা-ও নিশ্চিত নয় পুলিশ। তবে নগর পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ গণমাধ্যমকে জানান, বাবলাকে হত্যা করার জন্যই টার্গেট করে খুব কাছ থেকে গুলি চালানো হয়েছিল। পুলিশের একাধিক সূত্রের দাবি, কারাগারে থাকা শীর্ষসন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের নির্দেশে এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে তারই অনুসারীরা। জানতে চাইলে বায়েজিদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন বলেন, মামলা প্রক্রিয়াধীন।
তথ্যসূত্র বলছে, একসময় ছোট সাজ্জাদ ও সরোয়ার হোসেন বাবলা একসঙ্গেই সন্ত্রাসী কর্মকা- চালালেও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিভক্ত হয়ে পড়েন দুজন। স্থানীয় নির্মাণাধীন ভবনে চাঁদাবাজির ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে তাদের মধ্যে বিভক্তি শুরু হয় বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র। এই দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। গত ৩০ মার্চ নগরীর বাকলিয়া এলাকায় বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ সময় বাবলা জীবন নিয়ে পালিয়ে আসতে পারলেও ঘটনাস্থলে নিহত হন তার দুই সহযোগী বখতিয়ার হোসেন মানিক ও আবদুল্লাহ আল রিফাত। সেই ঘটনার সাত মাস পার না হতেই নিজের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় খুন হন সরোয়ার। গত বুধবার বিকেলে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ নির্বাচনি প্রচারণার সময় নগরীর বায়েজিদ থানার চালিতাতলী খন্দকারপাড়া এলাকায় মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যা করা হয় পুলিশের তালিকাভুক্ত এই শীর্ষ সন্ত্রাসীকে। এসময় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহসহ আহত হন চারজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছিুক স্থানীয় এক নেতা জানান, বায়েজিদ থানাধীন চালিতাতলী সরোয়ার হোসেন বাবলার নিজের নিয়ন্ত্রিত এলাকা। এই এলাকায় এসে তাকে হত্যার চিন্তা করা অনেক সাহসের ব্যাপার। যারাই এই হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা সরোয়ারের গ্রুপসহ পুলিশ প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ দিয়েই এই হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটিয়েছে। যোগ করেন তিনি।
নিহত সরোয়ারের বাবা আবদুল কাদেরের দাবি, ‘প্রায় সময় ফোনে আমার ছেলেকে গালাগাল করত রায়হান। হুমকি দিত। তারা মনে করত, বুড়ির নাতি সাজ্জাদকে গ্রেপ্তারের পেছনে আমার ছেলের হাত আছে। আমরা সাজ্জাদের অনুসারী রায়হানসহ চারজনের বিরুদ্ধে থানায় জিডিও করেছিলাম। সরোয়ারের আইনজীবীসহ অনেকেই তাকে সতর্ক থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু বাড়ির সামনে এভাবে খুন করতে পারে, তারা ভাবেননি।’
নগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর সরোয়ার কারাগার থেকে জামিনে বের হন। গত এক মাস আগে বিয়ে করেন সরোয়ার। নিহত সরোয়ার হোসেন বাবলা পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তার নামে হত্যা মামলাসহ অন্তত ১৫টি মামলা রয়েছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ‘সন্ত্রাসী’ সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদের নির্দেশে সরোয়ারকে গুলি করা হয়। ছোট সাজ্জাদ বিদেশে পলাতক শিবির ক্যাডার হিসেবে পরিচিত সাজ্জাদ আলীর অনুসারী।
২০০০ সালের ১২ জুলাই বহদ্দারহাটে সন্ত্রাসী হামলায় ছাত্রলীগর ছয় কর্মীসহ আটজন নিহত হন। সে ঘটনায় করা মামলায় সাজ্জাদ আলী (বড় সাজ্জাদ) সাজাপ্রাপ্ত হলেও পরে উচ্চ আদালত থেকে খালাস পান। নগর পুলিশের অভিমত, বিদেশে থাকলেও নগরীর বায়েজিদ, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও ও হাটহাজারীর একাংশের চাঁদাবাজিসহ অপকর্মের মূল হোতা বড় সাজ্জাদ। মূলত তার নির্দেশেই এসব অপকর্ম করতেন অন্যতম সহযোগী ম্যাক্সন ও সরোয়ার।
নগর পুলিশের অপরাধ বিভাগ বলছে, ২০১১ সালের ১৬ জুলাই একে-৪৭ রাইফেলসহ পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বাহ্মণবাড়িয়া থেকে ম্যাক্সন ও সরোয়ারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২০১৩ সালের ১৫ নভেম্বর ঈদের আগের রাতে দুই সন্ত্রাসী সরোয়ার ও ম্যাক্সন জামিনে মুক্তি পান। জামিন নিয়ে প্রথমে কাতার এবং পরে ভারতে পালিয়ে যান ম্যাক্সন। ২০২২ সালে সেখানে আত্মহত্যা করেন।
২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট চট্টগ্রামের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক এবং যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ মোছাম্মৎ বিলকিস আক্তার অস্ত্র মামলার রায়ে নুরুন্নবী প্রকাশ ম্যাক্সন, সরোয়ার এবং মানিক ওরফে গিট্টু মানিককে ২১ বছরের কারাদ-ের আদেশ দেন। রায়ের সময় সরোয়ার ও ম্যাক্সন আদালতে হাজির থাকলেও মানিক জামিনে বের হয়ে পলাতক থাকেন। ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট জামিনে মুক্ত হয়ে কাতারে চলে যান সরোয়ার ও ম্যাক্সন। ২০২০ সালে কাতার থেকে দেশে ফিরলে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সরোয়ারকে গ্রেপ্তার করে ইমিগ্রেশন পুলিশ। পরে তাকে বায়েজিদ বোস্তামী থানায় হস্তান্তর করা হয়।
তথ্য-উপাত্ত বলছে, ম্যাক্সন মারা যাওয়ার পর ছোট সাজ্জাদকে নিজ দলে ভেড়ান বড় সাজ্জাদ। নগরীর বায়েজিদ, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও ও হাটহাজারীর একাংশে ফের সক্রিয় করেন তার বাহিনী। বড় সাজ্জাদের অনুসারী হলেও বিগত সরকারের সময় নগর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাদের নির্দেশে নির্মাণাধিন ভবন থেকে চাঁদাবাজি শুরু করেন ছোট সাজ্জাদ ও তার বাহিনী। সরকার পরিবর্তনের পরে সরোয়ার জামিনে বের হয়ে আসার পর এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। ইট-বালু ও পাথর সাপ্লাইয়ের নিয়ন্ত্রণ নিতে নিজের অপকর্মের সঙ্গে তাহসিনকে নামে এক সন্ত্রাসীকে যুক্ত করেন। পট পরিবর্তনের পর রাজনৈতকি পরিচয় বদল করে বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন সরোয়ার। বিভিন্ন সময়ে বিএনপির বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে দেখা গেছে তাকে। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদ্য সাবেক যুগ্ম মহাসচিব লায়ন আসলাম চৌধুরীর আনুগত্য প্রকাশ করে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে লাগানো পোস্টারে নিজের ছবির সঙ্গে আসলাম চৌধুরীর ছবি ব্যবহার করতে দেখা গেছে সরোয়ারকে। এ ছাড়া বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সক্রিয় উপস্থিতি ছিল সরোয়ারের।
এদিকে চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিএনপি প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর নির্বাচনি গণসংযোগকালে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে মহানগর বিএনপির কার্যালয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় নাসিমন ভবনের চত্বরেই এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সমাবেশে প্রধান অতিথি চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, হামলা জাতীয় নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্রের অংশ। তিনি প্রশাসনের প্রতি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হামলাকারী ও অস্ত্রধারীদের আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানান।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মুহাম্মদ নাজিমুর রহমান এবং সাবেক সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর বলেন, নির্বাচনি মাঠে হামলা-হুমকি বিএনপিকে ভয় দেখাতে পারবে না এবং জনগণের সমর্থনে সন্ত্রাসবাদ পরাজিত হবে। সভা শেষে আগামীকাল শনিবার দলের কার্যালয়ের মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের কথাও জানানো হয়। এ ছাড়াও এ হামলার প্রতিবাদে গতকাল চট্টগ্রামে বিক্ষোভ মিছিল করেছে যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন