একদিকে লোক দেখানো অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের কার্যক্রম, অন্যদিকে কোম্পানির কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকতার যোগসাজশে অবৈধ সংযোগের ছড়াছড়ি; এমনই চলছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে। সংযোগ বিচ্ছিন্নের চাইতে কয়েক গুণ বেশি গতিতে চলে এখানকার চক্রগুলোর অবৈধ সংযোগ দেওয়ার তৎপরতা। শুধু তাই নয়, গ্যাস চুরি করে সিস্টেম লস দেখিয়ে বছর বছর হাতিয়ে নেওয়া হয় হাজার কোটি টাকা। সাম্প্রতিক সময়গুলোয় এসব কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিতাসের জেনারেল ম্যানেজার সৈয়দা আতিয়া বিলকিস।
অভিযোগ রয়েছে, একসময় দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) কমিশনারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে অনেককেই হয়রানি করেছেন তিনি। এখন নিজেই ফেঁসে যাচ্ছেন সেই দুদকের জালে। এরই মধ্যে তার দুর্নীতি, অনিয়ম ও অবৈধ সম্পদের খোঁজে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন; বেশ কয়েকবার হাজিরাও দিয়েছেন তিনি। তবে তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে কোম্পানির অন্য কর্মকর্তাদের হিংসা এবং প্রতিবেশী একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করছেন তিতাসের এই প্রভাবশালী কর্মকর্তা।
তিতাসের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে কোম্পানির সিস্টেম লস হয়েছে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। তখন দৈনিক প্রায় এক হাজার ৩৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেয়েছিল তিতাস। বিক্রি দেখানো হয়েছে দৈনিক প্রায় এক হাজার ১৮৯ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ ওই মাসে দৈনিক প্রায় ১৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস (১৪ কোটি ইউনিট) বিক্রির টাকা কোম্পানির কোষাগারে জমা দিতে পারেননি তিতাসের কর্মকর্তারা। যার পুরো দায়ভার আতিয়া বিলকিসকেই দিচ্ছেন তিতাসের কর্মকর্তারা। তাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ আমলে সব সুবিধা ভোগ করে এখন ভোল পাল্টে বর্তমান সরকারের কাছ থেকেও বাগিয়ে নিয়েছেন কোম্পানির অন্যতম শীর্ষ পদ।
আওয়ামী সরকারের শেষদিকে দুদকের সবচেয়ে প্রভাবশালী কমিশনার ছিলেন মোজাম্মেল হক খান। তার সঙ্গে ব্যাপক দহরম-মহরম ছিল আতিয়া বিলকিসের। সেই ঘনিষ্ঠতার সুযোগে দুদককে ব্যবহার করে অনেককে হয়রানি করেছেন, এখনই নিজের খোঁড়া গর্তেই তিনি পড়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন অনেক কর্মকর্তা।
অনুসন্ধানের জানা যায়, দুদকের একসময়কার প্রভাবশালী কমিশনার মোজাম্মেল হক খানের সঙ্গে ছিল সৈয়দা আতিয়া বিলকিসের ব্যাপক খাতির। মোজাম্মেল হক খান দুদকে যোগ দেওয়ার আগে ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে, তারও আগে ছিলেন জ্বালানি ও খনিজ বিভাগের সচিব। মোজাম্মেল হক খান জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব পদে থাকাকালে আতিয়া বিলকিসের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি দুদকে যোগদানের পর আগের পরিচয়ের সূত্র ধরে আতিয়া বিলকিস বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। যারাই তার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতেন, তাকেই তিনি দুদকে নিয়ে হয়রানি করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রমোশন পেতে যেহেতু দুদকের এনওসি লাগেÑ সেটাকেই তিনি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেন। এমনকি সে সময়কার তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদেরও থোরাই কেয়ার করতেন তিনি। অফিসে আসা-যাওয়া করতেন তার খেয়াল খুশিমতো। দুদক কমিশনারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে অন্যরাও তাকে ঘাটাতেও সাহস পেতো না কেউ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিতাসের এক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘সৈয়দা আতিয়া বিলকিসের ভয়ে আমরা তটস্থ থাকি। তার অনিয়মের বিরুদ্ধে ভয়ে আমরা কথা বলতে পারি না। তার সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে কথা বলেছি জানতে পারলে আমার চাকরি থাকবে না। দয়া করে আমার নামটি কোথাও ব্যবহার করবেন না।’
সম্প্রতি আতিয়া বিলকিস ছেলেকে দেখতে যাওয়ার অজুহাতে কানাডা সফর করেন। সরকারি ছুটি শেষ হলেও দেশে না এসে ডি-নথিতে ফাইল তোলেন। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে এলে তদন্তে নামে তিতাস গ্যাসের একটি কমিটি। আর সেই তদন্তে উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ছুটি ছাড়াই বিদেশ সফরসহ তার একাধিক পাসপোর্ট রয়েছে। আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের বাইরে অবস্থানকালে ছুটি বাড়াতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত দূতাবাসের মাধ্যমে ছুটির আবেদন করতে হয়। কিন্তু আতিয়া বিলকিস কোনো রকম পূর্বানুমতি কিংবা আবেদন ছাড়াই কানাডায় চার দিন বেশি অবস্থান করেন।
তদন্ত কমিটির প্রধান জেনারেল ম্যানেজার (অর্থ) রশিদুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাকে আতিয়া বিলকিসের কানাডা সফরের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানাতে বলা হয়। আমি তার সঙ্গে কথা বলে দেখেছি অভিযোগটি সঠিক। সেখানে গিয়ে তিনি নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, এ কথা সঠিক তিনি কয়েক দিন বেশি ছিলেন। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।’
একদিকে অফিসিয়াল তদন্ত, অন্যদিকে দুদকের অনুসন্ধানÑ এ খবরে তিতাসের অনেক কর্মকর্তা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, প্রকৃতির বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে আতিয়া বিলকিসকে। তিনি অনেক নিরীহ কর্মকর্তাদের চরম হয়রানি করেছেন। ক্ষমতা অপব্যবহার করে উপযুক্ত হওয়ার আগেই প্রমোশন বাগিয়ে নিয়েছেন।
দুদকের দেওয়া নোটিশে তার পদোন্নতি সংক্রান্ত সব রেকর্ডপত্র, মানবসম্পদ বিভাগে থাকাকালে বদলীকৃত কর্মকর্তাদের তথ্য, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ায় দেওয়া গ্যাস সংযোগের তথ্য চাওয়া হয়েছে। ওই সময়ে মুড়াপাড়ায় গ্যাসের অবৈধ সংযোগের ছিল রমরমা অবস্থা। এ ছাড়া বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংযোগের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে কানাডায় পাচারের অভিযোগও রয়েছে আতিয়া বিলকিসের বিরুদ্ধে।
যেখানে দেশের জ্বালানির চাহিদা মেটাতে সরকার অন্তত ২৫ শতাংশ গ্যাস বিদেশ থেকে এলএনজি আকারে আমদানি করছে। আমদানি করা এসব গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিট ১৩ ডলার থেকে শুরু করে অনেক সময় ৪০ ডলারে ওঠানামা করে। সেখানে গ্যাস চুরি করেও কীভাবে আতিয়া বিলকিস দায়িত্বে টিকে আছেন জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘যেহেতু এটি দুদক তদন্ত করছে, তাই এই মুহূর্তে এ বিষয়ে কিছু করতে পারছি না। দুদকের তদন্ত প্রতিবেদন হাতে আসলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে নিজের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করে সৈয়দা আতিয়া বিলকিস রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার বয়স বর্তমানে ৫৮ বছর। এই বয়সে এসে দুর্নীতি আমি কেন করব। দুদকের হাজিরার সময়ও আমি বলেছি। খিলগাঁওয়ে আমার পৈতৃক দুই বিঘা জমি ছাড়া আর কোনো সম্পদ নেই। কানাডায় ছেলেকে পড়ানোর জন্য কোম্পানি থেকে এক কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছি।’ তাহলে দুদক যে তদন্ত করছে তা কি অন্যায্যÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘তিতাসের কেউ কেউ চায় না, কোনো মহিলা এত বড় পদে থাকুক। হিংসা থেকে তারা আমার বিরুদ্ধে রয়েছে। শুধু দুদক নয়, ভারতের একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও এখানে সক্রিয়। আপনি আমার কাছে এলে আমি সবাইকে একে একে দেখিয়ে দিতে পারব।’ কবে আসব জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি বেশ কয়েক দিনের ছুটিতে আছি। তাই আগামী কিছুদিন আমাকে পাবেন না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিতাসের আরেক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘তার চাকরিজীবনে অফুরন্ত ছুটি। এত ছুটি তিনি কীভাবে ভোগ করেন তা কেউ জানে না।’
বর্তমানে দেশে আট শ্রেণির গ্রাহকের কাছে গ্যাস বিক্রি করে সরকার। এর মধ্যে শিল্প খাতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৩০ টাকা, বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার ১৪ টাকা। প্রতি ইউনিট ১৪ টাকা ধরলে সিস্টেম লস ও গ্যাস চুরি মিলিয়ে দৈনিক প্রায় ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে, যার বেশির ভাগটাই গ্যাস চুরির মাধ্যমে লোপাট হচ্ছে।
গ্যাস খাতে সিস্টেম লসের নামে কর্মকর্তাদের প্রচলিত অপকর্মকে অনেকে চুরি বললেও বিইআরসির সাবেক সদস্য মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী এটাকে ডাকাতি উল্লেখ করে বলেন, ‘দুই থেকে তিন শতাংশ গ্যাস কমে গেলে সেটাকে সিস্টেম লস বা চুরি বলা যেত। কিন্তু যেখানে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাস উধাও করে দেওয়া হচ্ছেÑএটাকে ডাকাতি না বলে পারছি না। ডাকাতি বললেও কম বলা হবে। এসব কাজের সঙ্গে যারা জড়িত অবশ্যই তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত।’

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন