দশম গ্রেডে বেতনসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলনরতদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে গতকাল রোববার সকাল থেকে সারা দেশের স্কুলগুলোতে কর্মবিরতি পালন করেছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। ফলে দেশের প্রায় সব বিদ্যালয়ে বন্ধ ছিল পাঠদান কার্যক্রম। তবে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর কর্মবিরতি স্থগিতের ঘোষণা দেন শিক্ষকরা। তবে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শহিদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে। এর আগে গতকাল পুলিশের হামলার প্রতিবাদে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দারের পদত্যাগ দাবি করেন শিক্ষকরা। এদিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতন দুই ধাপ বাড়িয়ে ১১তম গ্রেডে উন্নীত করার প্রস্তাব পাঠিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে বছরে অতিরিক্ত ব্যয় হবে প্রায় ৮৩১ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষদের সঙ্গে গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে সচিবালয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সচিব আবু তাহের মো. মাসুদের নেতৃত্বে বৈঠকে বসেছিলেন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। বৈঠক শেষ হয় রাত সাড়ে ৯টায়। প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ বলেন, ‘আজ সোমবার বিকেল ৫টায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে আমাদের দাবির বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। আমরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করলেও শহিদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাব।’
মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার ১১৪ নম্বর ওমর ব্যাপারীকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন, ‘শিক্ষকদের ওপর হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’ বরিশালের হিজলা উপজেলার পশ্চিম চর বাউশিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ হাসান মাহমুদও জানিয়েছেন কর্মবিরতি চলার কথা।
এদিকে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের আরেকাংশ ‘প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের’ ব্যানারে একাদশ গ্রেডে বেতন, উচ্চতর গ্রেড নিয়ে জটিলতা নিরসন ও শতভাগ পদোন্নতি নিশ্চিত করতে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দিয়েছেন। এ মোর্চাভুক্ত সংগঠনগুলোর শিক্ষকরা কর্মবিরতি পালন করছেন না।
কেরানীগঞ্জের ২১নং চারিগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক ও ঐক্য পরিষদের নেতা শাহিনুর আল আমিন বলেন, ‘শিক্ষকদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছি। আহতদের সঙ্গে হাসপাতালে যেয়ে দেখা করেছি ও কথা বলেছি। তবে আমরা কর্মবিরতি পালন করছি না।’
দশম গ্রেডে বেতন ছাড়াও শিক্ষকদের বাকি দুইটি দাবি হলোÑ চাকরির ১০ ও ১৬ বছরে উচ্চতর গ্রেড পাওয়া নিয়ে জটিলতা নিরসন এবং শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতির নিশ্চয়তার দাবিতে গত শনিবার সকাল থেকে শহিদ মিনারে এ লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষকরা। ওই দিন বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তারা ‘কলম বিরতি কর্মসূচি’ পালনে মিছিল নিয়ে শাহাবাগের দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু করেন। ৪টার দিকে শাহবাগ থানার সামনে তাদের আটকে দেয় পুলিশ। এ সময় পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান, লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাসে কর্মসূচি প- হয়ে যায় শিক্ষকদের কর্মসূচি। এ সময় দেড় শতাধিক শিক্ষক আহত হওয়ার পাশাপাশি ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করেন শিক্ষক নেতারা।
যদিও ঢাকা মহানগর পুলিশের দাবি, আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে একটা দল ব্যারিকেড ভেঙে শাহবাগ মোড় পার হয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ কয়েক রাউন্ড সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান নিক্ষেপ করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পুলিশের বাধার মুখে শহিদ মিনারে ফিরে এসে রোববার থেকে কর্মবিরতির কর্মসূচি ঘোষণা করেন শিক্ষকরা। গত শনিবার মধ্যরাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে শিক্ষকরা ‘পুলিশের হামলার’ নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডে উন্নীত করার প্রস্তাব, বছরে লাগবে ৮৩১ কোটি ৯১ লাখ টাকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতন দুই ধাপ বাড়িয়ে ১১তম গ্রেডে উন্নীত করার প্রস্তাব পাঠিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে বছরে অতিরিক্ত ব্যয় হবে প্রায় ৮৩১ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ৪ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে লিখিতভাবে এই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তার আগে একই প্রস্তাব অর্থ বিভাগেও পাঠানো হয়। প্রস্তাবে বলা হয়, বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের কাজের গুণগত ও পরিমাণগত দিক দিয়ে আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন গ্রেড বাড়িয়ে ১০তম করার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা সম্মতি দিয়েছেন। তাই যৌক্তিকতা বিবেচনা করে সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১১তম গ্রেডে উন্নীত করা প্রয়োজন।
বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকেরা ১৩তম গ্রেডে বেতন পান। প্রস্তাব অনুযায়ী, নতুন কাঠামোয় তারা ১১তম গ্রেডে চলে আসবেন। এতে প্রত্যেক শিক্ষকের বেতন গড়ে কয়েক হাজার টাকা বৃদ্ধি পাবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি ও পেশাগত মর্যাদা বিবেচনায় নিয়ে এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এখন অর্থ বিভাগ ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুমোদনের পর বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৭টি। এসব বিদ্যালয়ে ৩ লাখ ৮৪ হাজার শিক্ষক কর্মরত আছেন।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন