বছরের পর বছর ধরে বিকল ও অচলাবস্থায় পড়ে আছে রাজধানীর চারটি ফুট ওভারব্রিজে সংযুক্ত সচল সিঁড়ি তথা এস্কেলেটর। ফার্মগেট, বনানী চেয়ারম্যানবাড়ি, প্রগতি সরণিতে যমুনা ফিউচার পার্ক শপিং মলের সামনে এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বিমানবন্দর বাসস্ট্যান্ডের ফুট ওভারব্রিজগুলোতে সংযুক্ত এসব সিঁড়ি। চালু হওয়ার পর কয়েক বছর ঠিকঠাক চললেও, এখন সেগুলো পরিত্যক্ত। যদিও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ফুট ওভারব্রিজগুলোয় নতুন করে এস্কেলেটর স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নির্মল বায়ু, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের (কেইস) আওতায় বনানীর চলন্ত সিঁড়ি ২০১৪ সালে বসানো হয়। দেশের কোনো ফুট ওভারব্রিজে এটিই প্রথম চলন্ত সিঁড়ি সংযোজনের নজির। পরবর্তী সময়ে এই সিঁড়ির আদলে বিমানবন্দরের ব্রিজে এস্কেলেটর স্থাপন করে ডিএনসিসি। ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট চার কোটি ৮৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত চলন্ত সিঁড়িটি উদ্বোধরেন করেন তৎকালীন ডিএনসিসি মেয়র আনিসুল হক। ২০২৩ সালের অক্টোবরে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় ফার্মগেট ফুট ওভারব্রিজের চলন্ত সিঁড়ি। এই সিঁড়ি সংযোজনে ব্যয় হয়েছিল ২০ কোটি টাকা। তবে উদ্বোধনের এক সপ্তাহ পরেই বাঁশ দিয়ে ব্রিজ ব্যবহারের প্রান্তগুলো আটকে দেওয়া হয়েছিল। তার পর থেকে সেটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। অবশ্য মাঝে মাঝে চালু থাকে ইসিবি চত্বরের ফুট ওভারব্রিজে সংযোজিত এস্কেলেটর। এই সবগুলো চলন্ত সিঁড়িই দেখভাল করছে ডিএনসিসি।
ফার্মগেট, বনানী এবং প্রগতি সরণির ফুট ওভারব্রিজের আশপাশের লোকজনকে চলন্ত সিঁড়ি বিকল থাকার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। সিঁড়িগুলো এত দিন ধরে বিকল যে, ঠিক কবে থেকে চলন্ত সিঁড়ি চলছে না, সে বিষয়টি তারা মনেও করতে পারছেন না। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চালু হওয়ার পর কিছুদিন সেগুলো চলত। তার পর থেকে অকেজো হয়ে পড়ে। সিঁড়িগুলো অচল থাকায় ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ পথচারীদের। বিশেষ করে বিমানবন্দর বাসস্ট্যান্ড ফুট ওভারব্রিজে মালামাল নিয়ে সড়ক পারাপার করতে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় পথচারীদের।
সরেজমিনে দেখা যায়, মহাখালী হয়ে বিমানবন্দর যাওয়ার পথে, মূল সড়কে কোনো জেব্রা ক্রসিং বা সিগনাল নেই। অর্থাৎ রাস্তা দিয়ে পারাপার হওয়া নিষিদ্ধ। ফলে পথচারীদের একমাত্র ভরসা এখানকার দুটি ফুট ওভারব্রিজ। তবে বনানীর চলন্ত ব্রিজটি এখন চরম ঝুঁকিপূর্ণ। দুই পাশে সংযোজিত চলন্ত সিঁড়ি দীর্ঘদিন ধরেই নষ্ট। জংধরা কাঠামো, ধাপগুলো কয়েক জায়গায় দেবে গেছে। খুলে নেওয়া হয়েছে অনেক যন্ত্রাংশ। বেরিয়ে পড়েছে লোহা-লক্কড়ের কাঠামো। এমনকি স্টিলের কয়েকটি ধাপও নেই। সিঁড়ির ধাপগুলোয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আপত্তিকর জিনিসপত্র। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত বাড়লেই ফুট ওভারব্রিজে আনাগোনা শুরু হয় মাদকসেবী এবং ভ্রাম্যমাণ পতিতাদের। অনেক সময় তারা এস্কেলেটরের থেমে থাকা সিঁড়িতেই বসে থাকেন। সিঁড়িতেই চলে মাদক সেবনসহ অসামাজিক কার্যকলাপ। এই ব্রিজ দিয়ে মানুষ চরম ঝুঁকি নিয়ে দিনে পার হলেও, রাতে এমুখো হন না। পথচারীরা রাস্তা পারাপারের জন্য চলন্ত সিঁড়ির বিপরীতে থাকা হাঁটা সিঁড়ি দিয়েই ওঠানামা করছেন। এতে করে চলন্ত সিঁড়ি ব্যবহার করে শিশুসহ বয়োবৃদ্ধদের সহজ পারাপার এখন কঠিন যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে।
বিমানবন্দর বাসস্ট্যান্ডের ফুট ওভারব্রিজের পাশের চা বিক্রেতা আসলাম উদ্দিন বলেন, ‘একদিকে এয়ারপোর্ট আরেক দিকে রেলস্টেশন। প্রচুর মানুষ এখানে লাগেজ (ব্যাগ) নিয়ে রাস্তা পারাপার করেন। তাদের অনেকের কষ্ট হয়, দেখি। সিঁড়িগুলো চলে না। চললে অনেকের কষ্ট কম হতো।’ এই কথোপকথনের সময়েই এক বয়স্ক পথচারী প্রতিবেদককে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘লেখেন লেখেন। আপনারা লিখলে যদি এটা চালু হয়।’ এ সময় তার সঙ্গেও দুইটি ব্যাগ দেখা যায়। জিজ্ঞেস করলে জানান যে, ব্যাগগুলো নিয়েই সিঁড়ি বেয়ে রাস্তা পার হয়েছেন তিনি। একই স্থানে বেশ কয়েকজন পথচারীকে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পার হতে দেখা যায়। মাথার ওপরে ফুট ওভারব্রিজ থাকলেও, সেগুলো ব্যবহারে তাদের আগ্রহী দেখা যায়নি।
ব্রিজের পাশের এক দোকানদার জানান, রাত হলে মাদকসেবী, ভবঘুরেসহ ছিনতাইকারীদের আনাগোনা বাড়ে। ঠিকমতো আলো না থাকায় মানুষ উপরে উঠতে সাহস পায় না। এক শিক্ষার্থী বলেন, ব্রিজে উঠলেই দুর্গন্ধ ও ভিক্ষুকদের ভিড়ে হাঁটা যায় না, বরং ঝুঁঁকি নিয়ে রাস্তা পার হওয়াই সহজ।
মো. নুরুউদ্দিন নামের এক পথচারী বলেন, চলন্ত সিঁড়িটি চালু থাকলে বৃদ্ধ, অসুস্থ রোগীসহ শিশু-মহিলাদের জন্য সুবিধা হতো। তবে বন্ধ থাকায় সুবিধার চেয়ে দুর্ভোগ বেশি। ধাপগুলো বেশি উঁচু এবং চিপা হওয়াতে এটি ব্যবহার করা কষ্টকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ।
ফার্মগেটের ফুট ওভারব্রিজে গিয়ে সেটি হকার মার্কেট নাকি ব্রিজ, সেটি বুঝতেই প্রথমে হিমশিম খেতে হয়। হকারদের দখলে থাকা এই ব্রিজের চলন্ত সিঁড়িগুলোও বিকল হয়ে পড়ে আছে। ব্রিজের পাশেই সরকারি বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষার্থী মারুফ ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘কলেজে ভর্তি হওয়ার পর কখনো এই সিঁড়ি চলতে দেখিনি। সাধারণ সিঁড়ি দিয়েই রাস্তা পারাপার করি। কখনো ক্লান্ত থাকলে আর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে ইচ্ছা করে না। তখন রাস্তা দিয়ে পার হয়ে যাই।’
ব্রিজগুলোর দেখভাল ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি)। ব্রিজগুলোর অকেজো হওয়ার কারণ জানতে চাইলে ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ রূপালী বাংলাদেশকে জানান, সেগুলোর মেয়াদ শেষ। শিগগিরই নতুন চলন্ত সিঁড়ি সংযোজন করা হবে। ডিএনসিসি প্রশাসক বলেন, ‘এগুলোর (এস্কেলেটর) মেয়াদ শেষ। নতুন সিঁড়ি সংযুক্ত করা হবে। এ জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। কাজ চলছে। আশা করা যায়, ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির শুরুতেই সেগুলো চালু হবে।’ অকেজো তিনটির সঙ্গে আর কোনো ফুট ওভারব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি সংযোজন করা হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে এজাজ বলেন, ‘আমাদের সেই সময়ও নেই, টাকাও নেই। আপাতত এগুলোই চালু করতে চাই।’

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন