শনিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৯, ২০২৫, ১২:২৩ এএম

ব্যর্থতা ঢাকতে জঙ্গি নাটক সাজাত আ. লীগ সরকার

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৯, ২০২৫, ১২:২৩ এএম

ব্যর্থতা ঢাকতে জঙ্গি নাটক  সাজাত আ. লীগ সরকার

বাংলাদেশে গত দেড় দশক ধরে চালানো তথাকথিত জঙ্গিবিরোধী অভিযানগুলো মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবস, জাতীয় নির্বাচন অথবা রাজনৈতিক উত্তেজনার আগমুহূর্তে হঠাৎ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ‘জঙ্গি আস্তানা’র সন্ধান, ‘বড় হামলা নস্যাৎ করা হয়েছে’ এমন খবর প্রচার করা হতো। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে জঙ্গি নাটকের দৃশ্যপট। রাজনৈতিক ও অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, দেশের মানুষ আগে থেকেই জঙ্গি নাটকে বিশ্বাস করত না। ক্ষমতায় টিকে থাকতে এটি ছিল শেখ হাসিনার সরকারের একটি নাটক। তারা জামায়াত ও বিএনপিপন্থি নেতাকর্মীদের ধরে এনে জঙ্গি নাটক করতেন এবং শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে এসব ‘জঙ্গি জঙ্গি’ খেলা করতেন পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকর্তা।

পুলিশ সদর দপ্তর ও গোয়েন্দা পুলিশের একটি বিশেষ শাখার তথ্যমতে, গেল ১১ বছরে ১ হাজার ৭৮ জন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের দাবি, এর মধ্যে বেশ কিছু লোককে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া ব্যক্তিদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা সঠিক পথে ফিরে এসেছে। গোয়েন্দারা বলছেন, হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে গত ১৫ মাসে দেশে কোনো জঙ্গি তৎপরতা দৃশ্যমান হয়নি। কোনো ক্ষেত্রেই দেখা দেয়নি হুমকি। তা ছাড়া জঙ্গিদের ধরতে কোনো আস্তানার সন্ধান ও গ্রেপ্তার করেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।  

ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ফ্যাসিবাদের সময় পুলিশ কথিত জঙ্গি গ্রেপ্তারের অভিযান চালিয়ে প্রায় ১১ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করে। রাষ্ট্রের এই কাজও সমালোচনার মুখে পড়ে। এ কারণে ‘জঙ্গি জঙ্গি’ নাটক দেশের মানুষ পছন্দ করে না। তবে আমাদের দেশে অন্য দেশের কিছু জঙ্গি ছিল, তাদের কেউ পলাতক এবং কেউ কেউ আমাদের নজরে রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক লে. কর্নেল (অব.) দিদারুল আলম জানিয়েছেন, বাংলাদেশে জঙ্গিদের উত্থান হচ্ছে, এদের দমাতে না পারলে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় অস্থিরতা তৈরি হবে- এভাবে ভারতীয়দের সহায়তায় ইউরোপ ও আমেরিকাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তাছাড়া শেখ হাসিনার শাসনামলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান মূলত ভারতীয় বয়ান এবং দীর্ঘ মেয়াদে ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের একটি হাতিয়ার ছিল। এসব বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ সফলও হয়েছে। এ কারণে ১৭ বছর তারা জুলুম-নির্যাতন করেছে দেশের মানুষের প্রতি। তিনি বলেন, বহির্বিশ্ব থেকে বড় ধরনের কোনো চাপের মুখে পড়তে হয়নি হয়তো। বাংলাদেশে জঙ্গি উত্থান রোধে আওয়ামী সরকার দরকার বলে বহির্বিশ্বের অনেক দেশকে বোঝাতে চেয়েছিল শেখ হাসিনা সরকার।

দেখা গেছে, বিগত সরকারের আমলে প্রেস ব্রিফিংগুলো ছিল প্রায়ই একই ভাষায়- ‘বড় হামলার পরিকল্পনা ভেঙে পড়েছে’, ‘ষড়যন্ত্র ধ্বংস করা হয়েছে’, ‘জঙ্গিদের জাল উপড়ে ফেলা হয়েছে’। অথচ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে কোনো বড় জঙ্গি হামলা, অভিযান বা জঙ্গিবিরোধী কোনো নাটক দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতি এক জটিল প্রশ্নকে সামনে এনেছে তা হলো- এত দিন ধরে যাদের ‘সক্রিয় জঙ্গি’ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছিল, তারা হঠাৎ করে কোথায় গেল?

আওয়ামী লীগ ব্যর্থতা ঢাকতে রাষ্ট্রীয় মদদে একের পর এক জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ করে:

আওয়ামী লীগ ব্যর্থতা ঢাকতে রাষ্ট্রীয় মদদে একের পর এক জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ করে। ওই আমলে এমন একটা চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ যেন জঙ্গির অভয়ারণ্য। ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ঘটনার ধারাবাহিকতা দেখলে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের অসারতা ফুটে ওঠে। ২০০৯-১০ সালে জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের নামে প্রথম দফা গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হয়। ২০১১ সালে রাজশাহী, দিনাজপুর ও ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে বিস্ফোরক উদ্ধার এবং ২০১৩ সালে শাহবাগ-হেফাজত উত্তাপের সময়ে নানা স্থানে নাটকীয় গ্রেপ্তার-নির্দেশনা ছিল। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে অনেককে ‘জঙ্গি সন্দেহে’ আটক করা হয়; ব্লগার হত্যাকা-ের পর বিভিন্ন অভিযানে অনেককেই হত্যা করা হয় বন্দুকযুদ্ধে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার পর অনেক অপারেশন চালানো হয়। ‘থান্ডারবোল্ট’, ‘শোলাকিয়া’, ‘সানডেভিল’, ‘ইগল হান্ট’ ইত্যাদি।

এদিকে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সময়ে সিলেটের শিববাড়ী, আশকোনা, কল্যাণপুর, গাজীপুরসহ জেলায় জেলায় অভিযানে অনেক তরুণকে জঙ্গি তকমা দিয়ে হত্যা করা হয়। কোভিডকালে বড় আকারের হামলার নাটক না থাকলেও গ্রেপ্তার অভিযান চালু ছিল। ২০২৩-২৪ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিবসের আগে হঠাৎ করে ‘জঙ্গি গ্রেপ্তারের নাটক’ দফায় দফায় দেখা গেছে। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের পর এ ধরনের ঘটনা আর দেখা যায়নি।

প্রেস ব্রিফিংয়ের একই ধরনের বর্ণনা: হাসিনার জমানায় প্রতিটি ঘটনায় একটি মৌলিক প্যাটার্ন দেখা গেছে।  প্রেস ব্রিফিংয়ের একই ধরনের বর্ণনা, নিহতদের কখনোই জীবিত অবস্থায় আদালতে হাজির না করা, মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলে থাকা এবং প্রমাণের স্বচ্ছতার অভাব। অনেক পরিবারের অভিযোগ, তাদের সন্তানরা বিচ্ছিন্নভাবে বা কয়েক মাস আগে থেকেই নিখোঁজ থাকলেও পরবর্তী সময়ে সংবাদে ‘অভিযানে নিহত’ দেখানো হয়। কিছু ক্ষেত্রে মামলা-নথি ও চার্জশিট বিশ্লেষণে স্পষ্ট ফাঁক দেখা গেছে। র‌্যাব, সিটিটিসি, ডিবি- এই সংস্থাগুলো অভিযানে প্রধান ভূমিকা পালন করলেও কিছু গোয়েন্দা কর্মকর্তা পরে স্বীকারও করেছেন যে রাজনৈতিক চাপ ছিল। এমনকি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততার অভিযোগও মিলেছে।

হাসিনার ‘জঙ্গি কার্ড’ নীতিতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে তরুণেরা:

হসিনার ‘জঙ্গি কার্ড’ নীতিতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে তরুণদের। যাদের ‘নিহত’ বলা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই ছিল ছাত্র, চাকরিপ্রার্থী বা দিনমজুর। সাধারণ মানুষ কেমন করে ‘সক্রিয় জঙ্গি’ হয়ে ওঠে, তাও প্রশ্নবিদ্ধ। জঙ্গি তকমায় গুম হওয়া বহু মানুষের পরিবারের একই অভিযোগ, তাদের সন্তানকে আগে অপহরণ করা হয়েছে, পরে ‘অভিযানে নিহত’ হিসেবে সরকারি বর্ণনায় উপস্থাপন করা হয়। নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী, সিলেটের শিববাড়ী- এসব কেস স্টাডি থেকে উঠে আসে একই প্যাটার্ন, অর্থাৎ নিখোঁজের পর ‘অভিযানে জঙ্গি নিহত’ হওয়ার বর্ণনা।

জঙ্গিবাদ ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামপন্থি ও বিরোধী দলগুলোকে দমন করা হতো:

রাজনৈতিক দিক থেকে ব্যাপারটি আরও সুস্পষ্ট। জঙ্গি কার্ড ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামপন্থি বা বিরোধী সংগঠনগুলোকে দমন করা, জনমনে ভয় সৃষ্টি করে সরকারের টিকে থাকার বৈধতা তৈরি করা এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নিজেকে ‘জঙ্গিবিরোধী নেতা’ হিসেবে পরিচয় করানো। এই উদ্দেশ্যগুলো বারবার চোখে পড়ে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরাও বিভিন্ন সময়ে এসব অভিযানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

বড় অংশই ছিল কৃত্রিমভাবে তৈরি করা গল্প: সম্প্রতি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এসব অভিযানের বড় অংশই ছিল কৃত্রিমভাবে তৈরি গল্প। পাশাপাশি এসব ‘জঙ্গি কার্ড’ রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক মঞ্চে স্বীকৃতি পেতে ও বিরোধী শক্তিকে দমন করতে এমন কৌশল নিয়েছিল হাসিনার সরকার। সাজানো জঙ্গি নাটক নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা এবং পুলিশ কমিশনারও বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, আওয়ামী সরকার পতনের পরেই হারিয়ে গেছে জঙ্গি নাটকের দৃশ্যপট! শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে হারিয়ে গেছে ১৭ বছরের ‘সক্রিয় জঙ্গি’ হামলার আতঙ্ক। মানুষ এসব পছন্দ করত না এটা কিন্তু পরিষ্কার। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো ধরনের জঙ্গি বা জঙ্গিবাদ নেই। বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশে জঙ্গিবাদের কোনো উত্থান হয়নি, সেটা আপনারা লক্ষ করছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, ‘দেশে কোনো জঙ্গি নেই। আওয়ামী লীগের সময় জঙ্গি নাটক সাজিয়ে নানা ধরনের অপকর্ম করা হয়েছে। তবে কিছু কিছু সময় দুষ্কৃতকারীরা দেশে নৈরাজ্য করার চেষ্টা করে, এসব বিষয়ে আমরা সতর্ক রয়েছি।

এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেছেন, আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ও সেনাবাহিনী সব সময়ই জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে, যার কারণে এই সরকারের আমলে জঙ্গিবাদের বিষয়টি একেবারেই সশস্ত্র বাহিনী নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আসলেই এই ১১ মাসে তেমন জঙ্গিদের আটক বা গ্রেপ্তার করেনি বিষয়টি এমন নয়। তবে সম্প্রতি নামকরা একটি সংগঠনের মূল হোতাদের আমরা ধরেছি। সবচেয় বড় কথা হলো, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা অভিযান পরিচালনা করে থাকি। এসব অভিযানে যদি কেউ জঙ্গি হিসেবে পরিচিত না হয়, তাহলে তাদের আমরা ছেড়ে দিয়ে থাকি। যদি কেউ অভিযুক্ত হয়, তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করি। কাজেই জঙ্গি নেই বিষয়টি এমন নয়। তবে এসব নির্ভর করে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে। তিনি বলেন, দেশকে নিরাপদ রাখতে এবং সব অপরাধের বিরুদ্ধে র‌্যাব সব সময় সতর্ক রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!