তপশিল ঘোষণার মাধ্যমে নির্বাচনি যাত্রার মূল ট্রেন চালু হলো গতকাল বৃহস্পতিবার। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। এ কারণে এই নির্বাচনকে কঠিন যাত্রা হিসেবে মনে করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে লেভেল প্লেয়িং শতভাগ নিশ্চিত করা হবে বলে দাবি করা হয়েছে ইসির পক্ষ থেকে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রতি উপজেলায় দুজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জারি করা হবে অন্তত ২০টি পরিপত্র।
এসব বিষয় নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতে প্রাসঙ্গিক সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিশ্চিত করা হবে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। তিনি বলেন, পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার জন্য ৩ লাখ ১০ হাজার ৪১৪ জন প্রবাসী নিবন্ধন করেছেন। গুগল প্লে স্টোর থেকে অ্যাপটি ডাউনলোড করতে পারবেন। তপশিল ঘোষণার পর ভোটের দায়িত্বে যারা থাকবেন, তারা ১৬ বা ১৭ ডিসেম্বর থেকে নিবন্ধন করতে পারবেন। কয়েদিরা ২১ থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত করতে পারবেন। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্বে মোতায়েনের পর পারবেন। ইসি সচিব বলেন, ‘পরিপত্র রেডি করা আছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য যা প্রাসঙ্গিত হবে, তার সব নিশ্চিত করব। দলগুলোরও সদিচ্ছা থাকতে হবে। নিশ্চয়ই তারা সহায়তা করবে। কেউ না মানলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ গাজীপুর ও বাগেরহাটের আসনসংক্রান্ত ইসির গেজেট অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে আখতার আহমেদ বলেন, ‘আদালতের রায় আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে গাজীপুর ও বাগেরহাটের আসনের গেজেট আদালতের আদেশ অনুযায়ী হবে।’ তিনি বলেন, ভোটের সময় প্রশাসনে রদবদল চলমান প্রক্রিয়া। ইসির অনুমতি, সম্মতি বা পরামর্শ সাপেক্ষে রদবদল করা হবে।
এদিকে তপশিল ঘোষণার পর আজ শুক্রবার থেকেই ভোটগ্রহণের দুই দিন পর পর্যন্ত প্রতি উপজেলা বা থানায় কমপক্ষে দুজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের উপসচিব মোহাম্মদ মনির হোসেন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ বিষয়ে জানানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯-এর আওতায় আসন্ন নির্বাচনে ভোটের আচরণবিধি কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠিটির অনুলিপি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, পুলিশ হেডকোয়ার্টার, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকসহ প্রয়োজনীয় দপ্তরে পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ সাংবাদিকদের জানান, তপশিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও উৎসবমুখর নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রায় ২০টি পরিপত্র জারি করবে। তপশিল ঘোষণার পরই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিপত্র জারি হবে। প্রথম পরিপত্রে বলা থাকবে কমিশনের অনুমতি ছাড়া কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি না করার নির্দেশনা। এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জুডিশিয়াল ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, ইতোমধ্যে লাগানো পোস্টার-ব্যানার অপসারণ এবং নির্বাচনি আচরণবিধি প্রতিপালনসহ অন্যান্য বিষয়ে পরিপত্র জারি হবে বলে জানান তিনি।
বিভিন্ন প্রজ্ঞাপনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা আরও বলেন, তপশিল ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি প্রজ্ঞাপন জারি হবে। এরপর রিটার্নিং অফিসার (আরও) ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এরপর নির্বাচন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন কমিটি গঠন করা হবে, যার মধ্যে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় সেল, ভিজিলেন্স অবজারভেশন টিম, জুডিশিয়াল ইনকোয়ারি কমিটি, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ সেল এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলি নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত নির্দেশনা।
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরাতে হবে প্রচারসামগ্রী :
এদিকে তপশিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের নির্বাচনি আচরণবিধি মেনে চলার নির্দেশনা দেওয়া হবে। অননুমোদিত পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণের জন্যও তাৎক্ষণিকভাবে নির্দেশনা জারি করে ইসি। এত দিন নির্বাচনি আমেজ ধারণ করে যেসব প্রার্থী ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড টাঙিয়েছেন, সেগুলো আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থী বা সংশ্লিষ্টদের সরিয়ে ফেলার নির্দেশনা দিয়েছে নাসির উদ্দিন কমিশন।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে ইসির দেওয়া এ-সংক্রান্ত একটি চিঠিতে বলা হয়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে তপশিল ঘোষণার কার্যক্রম চলমান। ওই নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের পোস্টার, ব্যানার, দেয়াললিখন, বিলবোর্ড, গেট, তোরণ বা ঘের, প্যান্ডেল ও আলোকসজ্জা ইত্যাদি প্রচারসামগ্রী ও নির্বাচনি ক্যাম্প থাকলে তা সংশ্লিষ্ট সম্ভাব্য প্রার্থী/ব্যক্তিদের তপশিল ঘোষণার পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিজ খরচে/দায়িত্বে অপসারণের জন্য নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন। ইসি জানায়, নির্ধারিত সময়ে উপযুক্ত প্রচারণাসামগ্রী অপসারণসংক্রান্ত কার্যক্রম বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়ে অনুরোধ করা হলো।
জুলাই অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া বাংলাদেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মাত্র দুই বছরের মাথায় এ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু হয়। এই সরকারের বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে ২০২৫ সালের ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হবে। পরে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোটের সিদ্ধান্ত হয়। ১৩ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দেন, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট হবে। ওই ঘোষণার সময়সীমার মধ্যে এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে এটিই প্রথম নির্বাচন। নির্বাচন পরিচালনায় ‘অনভিজ্ঞ’ এই অন্তর্বর্তী সরকার এবং ইসির অধীনে একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট হতে যাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন