ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনি ট্রেনে উঠেছে। বহু বছর পর এমন এক নির্বাচন সামনে এসেছে, যাকে ঘিরে জনমনে রয়েছে প্রত্যাশা, উত্তেজনা এবং শঙ্কার মিশ্র অনুভূতি। দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক টানাপোড়েন, সংঘাত, অচলাবস্থার পর জাতির সামনে আবারও এক ঐতিহাসিক সুযোগ এসেছে একটি সত্যিকারের অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজনের। এ সুযোগ বাস্তবায়ন করা শুধু নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নয়। সরকারের সদিচ্ছা, রাজনৈতিক দলের পরিপক্বতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেশাদার আচরণের ওপরই নির্ভর করছে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ। এই নির্বাচন তাই বাংলাদেশে রাষ্ট্রসংস্কার, গণতন্ত্রচর্চা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নতুন অধ্যায় রচনার এক ঐতিহাসিক সুযোগ।
বিগত দুই জাতীয় নির্বাচনের স্মৃতি এখনো জাতির সামনে প্রখর বাস্তবতার মতো দাঁড়িয়ে আছে। ২০১৪ সালের একতরফা ভোট, ২০১৮ সালের রাতের ভোট কিংবা ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচন নিয়ে দেশজুড়ে যে প্রশ্ন ওঠে, তা গণতন্ত্রের ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দেয়। সেই আস্থাহীনতার ফল ছিল ২০২৪ সালের জুলাইয়ের আন্দোলন, যা শুধু আওয়ামী লীগের পতনই ঘটায়নি, বরং প্রমাণ করেছে, চাইলেই জনগণকে জোর করে থামানো যায় না। গণতন্ত্রের স্রোত একসময় বাঁধ ভেঙেই বেরিয়ে আসে। আর সেই গণআন্দোলনের পর থেকেই দেশে নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে একটি বিশ্বাস। এবারের নির্বাচন সত্যিকার অর্থেই পরিবর্তনের দ্বার খুলতে পারে।
কিন্তু সম্ভাবনা থাকলেই সব সহজ হয় না। বরং তপশিল ঘোষণার পরই স্পষ্ট হয়ে গেছে, সামনে চ্যালেঞ্জের পাহাড়। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস জানিয়ে দেয়, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে হলে প্রথম শর্ত হলো সরকারের সদিচ্ছা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক আস্থা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকারের এই নিরপেক্ষতার ঘাটতিতে। বর্তমান সরকারকে তাই দেখাতে হবে, তারা সত্যিই ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের নীতিতে বিশ্বাসী।
নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব এবার বহুগুণ বেড়ে গেছে। অতীতের ক্ষমতাসীন দলের হয়ে প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত, প্রযুক্তিগত অস্বচ্ছতা এবং সক্ষমতার অভাব তাদের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করেছে। তাই এবার তাদের সামনে একটি দ্বৈত চ্যালেঞ্জ। একদিকে নির্বাচন আয়োজনের বিপুল কাজ, অন্যদিকে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনর্গঠন।
আরও গুরুত্বপূর্ণ হলোÑ রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা। প্রতিটি দলকে স্মরণ রাখতে হবে, এ নির্বাচন তাদের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার জায়গা নয়, বরং দেশের ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গা। বিরোধী দলগুলোকে উত্তেজনা বা সহিংসতার পথ পরিহার করে রাজনৈতিক যুক্তি, নীতি ও জনসংযোগের মাধ্যমে সামনে আসতে হবে। তাদেরকে মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রে প্রতিযোগিতা থাকবেই, কিন্তু প্রতিযোগিতা যেন সংঘাতে রূপ না নেয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা এবার নির্ধারণ করবে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা। অতীতে তাদের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, পক্ষপাতিত্ব বা ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ জনগণের মনে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। পুলিশের প্রতিটি সদস্য, বিজিবি, র্যাব কিংবা অন্যান্য বাহিনীকে ভুলে গেলে চলবে না, তারা জনগণের সেবক। নির্বাচনকালীন সময়ে তাদের পরিচয় একটাই, রাষ্ট্রের কর্মচারী, কোনো রাজনৈতিক দলের নয়।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ভোটারদের। তারা বহু বছর অপেক্ষা করেছেন একটি প্রকৃত নির্বাচনের জন্য। আন্দোলন করেছেন, রক্ত দিয়েছেন, রাস্তায় নেমেছেন। এখন সময় এসেছে সেই আন্দোলনের ফসল ব্যালটের মাধ্যমে বেছে নেওয়ার। জনগণ চায় স্থিতিশীলতা, কর্মসংস্থান, নিরাপদ জীবন, দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র এবং দায়িত্বশীল নেতৃত্ব। তারা প্রত্যাশা করছে, এ নির্বাচন যেন তাদের সেই স্বপ্নের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।
দেশ এখন নির্বাচনি ট্রেনে। ট্রেনের গতি বাড়ছে, স্টেশন বদলাচ্ছে, নতুন যাত্রী উঠছে, কেউ কেউ নামছে, কিন্তু গন্তব্য একটাই। গণতন্ত্রের মজবুত গড়ন। তবে এই ট্রেন সঠিক পথে যাবে কি না, তা নির্ভর করছে আমরা কীভাবে আগামী কয়েক সপ্তাহ আচরণ করি তার ওপর। সরকারের নিরপেক্ষতা, কমিশনের দক্ষতা, দলের পরিপক্বতা, বাহিনীর পেশাদারিত্ব সব মিলেই ঠিক করবে ২০২৬ কি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন ভোরের সূচনা হবে, নাকি আবারও হতাশার অন্ধকারে ডুবে যাবে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন