অভিনয়ের অভিনয় করে অভিনয় করা যায় না, অভিনয় তারাই করতে পারে, যারা অভিনয়কে ধারণ করে। থিয়েটারে পড়াশোনা করেই অভিনয় শেখা যায় না বরং অভিনেতারা থিয়েটারে পড়ে অভিনয়কে জীবিত রাখে। থিয়েটার বা নাট্যকলা এটি শুধু একটি বিষয় নয় বরং হাজারো শিল্পীর প্রাণ। সাধারণ মানুষের কাছে যেখানে থিয়েটারের কোনো মূল্য নেই বা তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয় না, তারই উল্টোদিকে শিপ্লীদের কাছে থিয়েটার একটি উচ্ছ্বাসের নাম। কারণ শিপ্লীরা থিয়েটার ধারণ করে, তারপর অভিনয় করে। তারা ভালোবেসে অভিনয় করে, বর্তমান সিনেমার ফ্রেমের জন্য নয় বরং তারা থিয়েটার কে নিজের সন্তানের মতো ধারণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য সব বিষয়ে সবাই ইঁদুর দৌড় প্রতিযোগিতার মতো মুখস্থ করতে পারলেও, থিয়েটার এসবের ব্যতিক্রম। কারণ থিয়েটারে অভিনয় করতে হয় মন থেকে। থিয়েটার চর্চা করতে হয়।
আমাদের দেশে প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটার বিভাগ রয়েছে। এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা, অন্য সকল বিভাগ থেকে কম হলেও, এর গুরুত্ব কমে যায় না। যেকোনো জাতীয় দিবস বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক আয়োজনের বেশিরভাগ দায়িত্ব এ বিভাগের ওপরই বর্তায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে অবহেলিত বিভাগ হলো থিয়েটার। আমাদের দেশে থিয়েটারের অবস্থা শুধু খারাপ নয় বরং খুবই খারাপ ও শোচনীয়।
বর্তমানে আমাদের দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটার বিষয়টাকে শুধু নামের জন্যই রেখেছে। নয়তো এ বিষয়ে পড়ে শিক্ষার্থীদের কোনো সুযোগ-সুবিধা তারা দিতে পরছে না।
দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটারের সমস্যাসমূহ
শিল্প হিসেবে অবমূল্যায়ন : বাংলাদেশের মতো একটি স্বল্প আয়ের দেশে যেখানে উচ্চশিক্ষিত এর হার খুবই কম। সেই দেশে থিয়েটারের মতো বিষয়কে অবহেলার চোখেই দেখা হয়। থিয়েটার যে চর্চা বা পড়াশোনা করার একটি বিষয় হতে পারে এ কথা কেউ মানতেই চায় না। তারা মনে করে নাটক মানেই অভিনয় আর অভিনয় করতে কোনো কষ্ট আছে নাকি তাই এটা নিয়ে পড়াশোনা করার কোনো দরকার নেই। কিন্তু অভিনয় করতে হলেও যে অনেক কিছু জানতে হয়, ভাব ভঙ্গি মন থেকে আনতে, চর্চা করতে হয়, ইতিহাস জানতে হয়, এ কথা কেউ মানতেই চায় না ফলে থিয়েটার থেকে যায় পেছনে।
পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই : দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই থিয়েটারের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, কখনো পর্যাপ্ত জায়গাও পাওয়া যায় না। থিয়েটার এমন একটি বিষয় যা চর্চা ছাড়া করা অসম্ভব। কিন্তু শিক্ষক, জায়গা ও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে চর্চার অভাবে এই ছোট বিষয় ছোট্টই থেকে যায়। শিক্ষার্থীদের বড় কিছু করে দেখানোর সুযোগই দেওয়া হয় না। আবার সেশনজট তো রয়েছেই।
শিপ্লী ও দর্শক দুজনেই হচ্ছে থিয়েটারবিমুখ : বর্তমান ডিজিটাল যুগে এসে মানুষ থিয়েটারের বিকল্প হিসেবে ফোনেই বিভিন্ন সিনেমা বা ছবি দেখে ফলে তারা আর থিয়েটারে যায় না। এখন দর্শক যদি থিয়েটারেই না যায় তাহলে শিপ্লীরা অভিনয় দেখাবে কাকে? আপনি মানেন আর নাই মানেন, বাংলাদেশে অন্যান্য বিষয়ে পড়াশোনা করার পাশাপাশি সবাই যেমন কিছু না কিছু কাজ করে আয় করে। থিয়েটার শিক্ষার্থীদেরও এই আয়টা প্রয়োজন। কিন্তু দিনশেষে যখন তারা অনেক কষ্ট করে একটা নাটক প্রস্তুত করে দেখে আসনে দর্শক খুবই কম তখন তাদের মনোবল ভেঙে যায় আর আয় তো হয়ই না। হয়তো তারা থিয়েটার বিষয়টাকে নিজের ভালোবাসার জায়গা থেকে বেঁছে নিয়েছে কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে পেট চলে না, দিনশেষে তাদেরও একটা অল্প অংশ আয় প্রয়োজন কিন্তু ওটা না পেয়ে ধীরে ধীরে তারাও থিয়েটারবিমুখ হয়ে যায়।
থিয়েটারের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি : বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ থিয়েটার এবং মিডিয়াকে এক মনে করে। কিন্তু থিয়েটার ও মিডিয়া এক নয়। দুটোকে এক মনে করার কারণে তারা ভাবে মিডিয়ার যেই খারাপ দিকগুলো রয়েছে তা হয়তো থিয়েটারেও রয়েছে ফলে অনেক পরিবার থেকে সন্তানদের থিয়েটার পড়তে দেওয়া হয় না। মানুষ থিয়েটারের নাম শুনলে বাঁকা চোখে দেখে। যা থিয়েটারকে দুর্বল করে দেয়।
উপরের এই কারণগুলোর জন্য আমাদের দেশে থিয়েটার পিছয়ে রয়েছে। অথচ বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে খুবই জাঁকজমকভাবে এখনো থিয়েটার পড়ানো হয়। বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটারের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে থিয়েটার চর্চার সুযোগ, পাশাপাশি বিভিন্ন প্রোডাকশনে কাজ করার সুযোগ ফলে তাদের আমাদের দেশের মতো কোনো সংকটে পড়তে হয় না।
থিয়েটার শুধু একটি বিনোদন মাধ্যম নয় বরং এটি গ্রামীণ সংস্কৃতি, ভাষা ও ইতিহাসের এক বাহক। থিয়েটার সমাজের বিভিন্ন অসংগতি, বৈষম্য সরাসরি তুলে ধরে। মঞ্চনাটকের মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি, শ্রেণির মানুষের গল্প উঠে আসে। ফলে দর্শকদের মধ্যে এটি সহমর্মিতা, সহনশীলতা ও অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়ায়। থিয়েটারের ‘মুখোশ নাটক’, ‘গাননাট্য’, ‘পালাগান’ এর মতো প্রোগ্রামগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক শিকড়কে ধরে রাখে। আর শিকড় ছাড়া কী কোনো জাতি বাঁচতে পারে? থিয়েটার শুধু শিকড় ধরে রাখে না বরং এটি মানুষকে চিন্তা করতে শিখায়, প্রশ্ন করতে শিখায়।
থিয়েটারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা : কথা বলার প্রকাশভঙ্গি, আত্মবিশ্বাস, নেতৃত্ব, দলগত কাজ ও সৃজনশীলতার মতো দক্ষতাগুলো অর্জন করে। যা যেকোনো কাজে লাগে। তাই থিয়েটারকে অবহেলার চোখে না দেখে, বরং সরকার ও আমাদের উচিত কীভাবে আরও উন্নত করা যায় ওইদিকে নজর দেওয়া।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন