ভারত কর্তৃক বাংলাদেশে পুশইনের (ঠেলে দেওয়া) পর সীমান্তে আরও সতর্ক অবস্থান নিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি। এদিকে পাল্টা পুশব্যাক ঠেকাতে কৌশলী নীতি অবলম্বন করেছে ভারত। সিলেট সীমান্ত দিয়ে যাতে বাংলাদেশ তাদের ঠেলে দেওয়া (পুশইন) লোকজনকে পুশব্যাক না করতে পারে, সে জন্য মেঘালয় রাজ্য সরকার পুরো সীমান্ত এলাকায় রাত্রিকালীন (রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত) কারফিউ জারি করেছে। রাজ্যের সাউথ গারো হিলসের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হেমা নায়েক গত শুক্রবার রাতে এক আদেশে সিলেট সীমান্তের ভারতের অংশে এই কারফিউ জারি করেন। যদিও কারফিউর কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। সাউথ গারো হিলস থেকেও এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি।
বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রয়েছে বাংলাদেশও। সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ভারত সীমান্তে কারফিউ জারির বিষয়টি একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমরা বিষয়টির প্রতি গভীর মনোযোগ রাখছি। সরকারের ওপর মহলে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
এ অবস্থায় সিলেট বিজিবি সীমান্তে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। গত ৩ দিন ধরে ভারত কর্তৃক সীমান্তে ব্যাপক পুশইনের পর তারা সীমান্তে নজরদারি ও টহল আরও জোরদার করেছে। সিলেট সেক্টর কমান্ড থেকে ক্যাম্পে ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে সতর্ক বার্তা। বার্তায় পুশইন ঠেকাতে সীমান্তকে কঠোর নজরদারির ভেতর রাখতে বলা হয়েছে। বিজিবি সিলেট সেক্টরের ৪৮ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল নাজমুল হক জানান, আমাদের সীমান্ত সতর্ক রয়েছে। যেকোনো পুশইন আমরা ঠেকিয়ে দিতে প্রস্তুত। সেই সুযোগ দেব না। এ জন্য সীমান্ত এলাকায় পাহারা জোরদার করা হয়েছে।
বিজিবি ও প্রশাসন সূত্র জানায়, মৌলভীবাজারের তিন সীমান্ত দিয়ে ভারত গত ৩ দিনে একাধিকবার পুশইন করে। তবে সিলেট বা সুনামগঞ্জের কোনো সীমান্ত এলাকা দিয়ে এ রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। ভারত শতাধিক লোকজনকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। এদের মধ্যে সবাই বাংলাদেশি নন। কিছু রোহিঙ্গা ও ভারতীয় নাগরিক রয়েছে। যাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে। এদিকে যারা পুশইন হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছেন, তারা জানান, ভারত আরও অনেক লোক বাংলাদেশে পুশইন করতে চায়। এ জন্য সব প্রস্তুতিও তারা নিয়েছে। এদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিকরাও রয়েছেন, যারা মুসলিম। এরই মধ্যে কিছুসংখ্যক ভারতীয় নাগরিককে বিএসএফ বনের ভেতর রেখে গেছে। সময়মতো তারা তাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠাবে। এর আগে গত এক সপ্তাহে রোহিঙ্গাসহ দেড় শতাধিক লোককে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়েছে ভারত। আরও শতাধিক ব্যক্তিকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর পরিকল্পনার কথা বাংলাদেশের কূটনৈতিক পর্যায়েও অবগত। বাংলাদেশ এটিকে দুই দেশের সীমান্ত ব্যবস্থাপনার লঙ্ঘন মনে করছে এবং এ তৎপরতায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে।
বিজিবি ও বড়লেখা থানা সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার ভোরে বড়লেখা উপজেলার পাল্লাথলি ও নিউ পাল্লাথলি সীমান্ত দিয়ে অনেককে ঠেলে পাঠায় বিএসএফ। পরে বিজিবি ঘটনাস্থল থেকে তাদের আটক করে। তাদের মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে ৪৪ জনকে বিজিবি গতকাল শনিবার সকাল ১০টার দিকে বড়লেখা থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। তাদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে তারা ভারতে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ৩০ জনের বাড়ি নড়াইলে। অন্যদের বাড়ি সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ জেলায়।
ভারতের গণমাধ্যম জানিয়েছে, বিএসএফের তত্ত্বাবধানে দুই শতাধিক লোককে গুজরাট থেকে এনে ত্রিপুরা সীমান্তে জড়ো করে রেখেছে ভারত সরকার। দুই ভাগে ভাগ করে একটি ভাগকে রাখে আগরতলায় এবং আরেকটি ভাগকে নিয়ে আসা হয় সীমান্তে। এদেরকে এরই মধ্যে বাংলাদেশে তারা পুশইন করতে সক্ষম হয়। বাকিদেরও তারা ঠেলে দিতে সময়ের অপেক্ষায় রয়েছে। একটি সূত্র জানায়, এদের সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হতে পারে। তাদের নিয়ে এসে সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় রাখা হয়েছে। এই তথ্য জানতে পেরেছে বিজিবি। ফলে তারাও পুশইন ঠেকাতে সক্রিয় রয়েছে। মূলত ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভারত সীমান্ত দিয়ে পুশইন করছে।
এদিকে সিলেটের স্থানীয় প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার সিলেটের তামাবিল সীমান্তে উভয় দেশের সীমান্ত জরিপ চলাকালে বিএসএফকে বাধা দেয় স্থানীয় লোকজন। বাধার কারণে সীমান্ত জরিপ বন্ধ হয়ে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, সেই ঘটনার জের ধরে সীমান্তে কারফিউ জারি করা হয়ে থাকতে পারে।
কারফিউ জারির আদেশে বলা হয়, কারফিউ সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে ৫০০ মিটার পর্যন্ত এলাকায় প্রযোজ্য হবে। কারফিউ চলাকালে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ বা অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের উদ্দেশ্যে চলাফেরা, অবৈধ জমায়েত, মিছিল বা অস্ত্র, লাঠি, রড, পাথরসহ অন্যান্য অস্ত্রোপযোগী বস্তু বহন, গবাদি পশু, চোরাচালনের পণ্য, সুপারি, পানপাতা, শুকনো মাছ, বিড়ি, সিগারেট, চা-পাতা ইত্যাদি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। এলাকাকে ‘নিরাপত্তা সংবেদনশীল’ ঘোষণা করে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এটি সিলেট সীমান্তঘেঁষা মেঘালয় রাজ্যে ৮ মে থেকে কার্যকর হয়। যেদিন থেকে মূলত বাংলাদেশে পুশইন শুরু করে ভারত। ওই দিনই জরিপ নিয়ে তামাবিল সীমান্তে উত্তেজনা তৈরি হয়।
অপরদিকে ভারতের কমিরগঞ্জের একটি সূত্র জানায়, ভারত-পাকিস্তানের সংঘাতের কারণে অনেক মুসলিম প্রাণভয়ে ভারত ছাড়তে চাইছেন। ভারতে চলছে মুসলিমদের ওপর ধমন-পীড়নও। স্থানীয়ভাবেও অনেকে নির্যাতিত ও নিপীড়িতও হচ্ছেন। নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশ সীমান্তের আশপাশের ভারতের নাগরিকরাও বাংলাদেশকে নিরাপদ মনে করছেন। ভারতের কমিরগঞ্জ লন্ডনিপাড়ার আবদুস সালাম নামের সে দেশের এক নাগরিক টেলিফোনে রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ভারতে মুসলিম ধরপাকড় অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি। এটি অব্যাহতভাবে চলছে। বিশেষ করে শিলচর, করিমগঞ্জ, ত্রিপুরায় ধরপাকড়ে আতঙ্কিত সেখানকার মুসলিমরা। এই ধরপাকড় থেকে রক্ষা পেতে গোপনে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছেন কেউ কেউ। কেননা সীমান্তের ওপারে অনেকেরই আত্মীয়-স্বজন রয়েছেন। ভারত থেকে বাংলাদেশকে নিরাপদ মনে করায় তারা বাংলাদেশে ঢুকছেন। কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বড়লেখা, কুলাউড়া সীমান্ত দিয়ে তারা ঢুকছেন। তবে প্রশাসনের খাতায় তাদের কোনো তথ্য নেই।