জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ৯ মাস পার হলেও দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র থেমে নেই। পতিত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসররা নানা ধরনের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আত্মগোপনে থেকেও শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠরা মোটা অংকের অর্থ খরচ করে দেশবিরোধী নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন। একইসঙ্গে প্রতিবেশী দেশ ভারতের একাধিক গণমাধ্যমে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও ঘনিষ্ঠদের বিনিয়োগের তথ্য মিলেছে। আর সেইসব গণমাধ্যম থেকে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
বিভিন্ন জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রচারের শীর্ষে রয়েছে ভারতের সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল রিপাবলিক বাংলা। চ্যানেলটির মালিকানায় রয়েছেন দেশটির ক্ষমতাসীন দল বিজেপির ঘরের লোক হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামী। আর এই চ্যানেলে বাংলাদেশ বিরোধী নানা তথ্য ছড়াচ্ছেন সাংবাদিক ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যে জানা যায়, রিপাবলিক বাংলায় আওয়ামী লীগের তিন শীর্ষ নেতা ১০০ কোটি রুপি বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-৮ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বিনিয়োগ করেছেন ৫৫ কোটি রুপি। আর দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী শেখ সেলিম এবং নারায়ণগঞ্জের গডফাদার হিসেবে পরিচিত সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বিনিয়োগ করেছেন প্রায় অর্ধশত কোটি রুপি। তাদের বিনিয়োগ পেয়েই বাংলাদেশ বিরোধী তথ্য প্রচারে বেপোরোয়া হয়ে উঠেছে রিপাবলিক বাংলা। ইতোমধ্যেই চ্যানেলটি মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক তথ্য ছড়ানোর কারণে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
বাংলা সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল রিপাবলিক বাংলা ৫ আগস্টের আগে থেকেই বাংলাদেশ ও বিদেশে অবস্থানরত বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। মূলত বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যা সংবাদ ও গুজব ছড়ানোই তাদের প্রধান এজেন্ডা বা উদ্দেশ্য। চ্যানেলটির সিনিয়র এডিটর ও হেড অব ইনপুট হিসেবে কর্মরত ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ টেলিভিশনটির স্ক্রিনে কখনো লাফাচ্ছেন, কখনো দৌড়াচ্ছেন; আবার কখনো চিৎকার-চেঁচামেচি করছেন, বলছেন আজগুবি কথা এবং দিচ্ছেন নানা বিভ্রান্তিকর তথ্যও। ‘বাংলাদেশ থাকবে না। থাকবে না বাংলাদেশ। আজ আমি চিৎকার করব না। আমি রেগে কোনো কথা বলব না। আমি অভিমান করেছি। আমি শোকাহত; এমন অসংখ্য উদ্ভট কথার মাধ্যমে অনবরত বিভ্রান্তিকর তথ্য ও গুজবের জন্ম দিয়ে চলেছেন তিনি। চ্যানেলটির নারী উপস্থাপিকা স্বর্ণালী সরকার বাংলাদেশের বিনোদন তারকাদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে বলেছেন। শুধু রিপাবলিক বাংলা নয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে ভারতীয় অধিকাংশ গণমাধ্যম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে যাচ্ছে।
জানা যায়, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকেই আত্মগাপনে রয়েছেন আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। দলের পক্ষে মাঝে মাঝে ভিডিও বার্তাও দিচ্ছেন। তবে ভারতে অবস্থান করছেন এমনটি বলা হলেও তার অবস্থান সর্ম্পকে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আর শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ সেলিম এবং শামীম ওসমান ৫ আগস্টের আগেই যশোরের সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। শেখ সেলিমের সর্বশেষ অবস্থান জানা না গেলেও শামীম ওসমান বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে রয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনজনই গত দেড় দশকে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন। দেশে-বিদেশে অবৈধ সম্পদ গড়েছেন। আত্মগোপনে থেকেই একটি দ্বীপ-রাষ্ট্রের অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে রিপাবলিক বাংলা ও অর্ণব গোস্বামীর প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
সূত্র মতে, আওয়ামী লীগের এজেন্ডামাফিক অন্তর্বর্তী সরকারকে বিতর্কিত করা, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানকে দেশবিরোধী জঙ্গি আক্রমণ বলা, বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র বানানো ও হিন্দুদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে সাম্প্রদায়িক ইস্যু তৈরির জন্যই অনবরত প্রপাগান্ডা চালিয়ে যেতে শতকোটি রুপির লেনদেন হয়েছে। ভারতীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় বাহাউদ্দিন নাছিমের মধ্যস্থতায় অর্ণব গোস্বামীর সঙ্গে একটি গোপন চুক্তিও হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী প্রাথমিক একশ কোটি রুপি দেওয়া হলেও প্রতি মাসে দুই কোটি রুপি করে দেওয়া হচ্ছে।
বার্তা সংস্থা এএফপি বাংলাদেশের ফ্যাক্ট-চেকিং সম্পাদক কদরুদ্দিন শিশির রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ভারতের বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের অনেক গণমাধ্যম বাংলাদেশ ও এ দেশের মানুষকে ছোট করতে অপতৎপরতায় লিপ্ত। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার সহযোগিতায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালানো হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ও গোয়েন্দা সংস্থার মদদ ছাড়া তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশকে নিয়ে যে ধরনের অপসাংবাদিকতা করছে তা বিশ্বে বিরল। তিনি বলেন, সম্প্রতি ভারত সরকার বাংলাদেশের ছয়টি টেলিভিশন চ্যানেলের ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারেরও উচিত বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যা তথ্য ও গুজব তৈরির কারখানা ভারতীয় মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে আনা, না হলে বাংলাদেশ নিয়ে নেগেটিভ ন্যারোটিভ আরও বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে সতর্ক হতে হবে যাতে তাদের মতো অপসাংবাদিকতায় যুক্ত না হয়ে যায়।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটের সভাপতি আবু সালেহ আকন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা সারাবিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুণ্ণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এটা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছু নয়। ভারতীয় সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে এবং ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুথানে ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসরদের সহযোগিতায় ভারতীয় মিডিয়া সাংবাদিকতার নামে অপসাংবাদিকতা করছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, পুলিশ বাহিনীর প্রতিটি ইউনিট দেশবিরোধী তৎপরতা রূখতে নিয়মিত সাইবার পেট্রোলিং করছে। যারাই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকুক না কেনো, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। অভিযোগ উঠেছে, তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে প্রপাগান্ডা চালাচ্ছেন সেটি অত্যন্ত ‘সুপরিকল্পিত’। বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতীয় বেশিরভাগ মিডিয়া বাংলাদেশকে ‘জঙ্গি রাষ্ট্র’ হিসেবে পরচিতি করার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে, ‘রিপাবলিক বাংলা’ এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। চ্যানেলটি অনবরত গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। একই সঙ্গে ভারতীয় মূলধারার গণমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য হিন্দু, জি নিউজ, লাইভ মিন্ট, ইন্ডিয়া টুডে, রিপাবলিক, আজতাক, এবিপি আনন্দসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক বার্তা ছড়ানো হচ্ছে। এসব চ্যানেলে গত ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশকে নিয়ে করা বিভিন্ন রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তারা ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, র্যাবের ১৫টি ব্যাটালিয়ন, সদর দপ্তরের সাইবার ও গোয়েন্দা ইউনিট অনলাইন-অফলাইনে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের রূখতে তৎপর রয়েছে। প্রতিদিন সারা দেশে র্যাব অপরাধীদের গ্রেপ্তারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে।

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন