বাংলাদেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেল প্রকল্প এমআরটি লাইন-৬ বাণিজ্যিকভাবে চালু হওয়ার দুই বছর অতিক্রম করলেও এখনো প্রকল্পের জন্য প্রতিশ্রুত সরকারি সিড মানির পুরো টাকা পায়নি বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
সরকার এই প্রকল্পের পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও অবচয় ব্যয় নির্বাহের জন্য ১ হাজার কোটি টাকা অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে মাত্র ১৫০ কোটি টাকা। বাকি ৮৫০ কোটি টাকা এককালীন পাওয়ার দাবিতে প্রতিষ্ঠানটি বারবার অনুরোধ জানালেও অর্থ বিভাগ তা এখনো ছাড় করেনি। ডিএমটিসিএলের এক চিঠির সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে, যার একটি অনুলিপি রূপালী বাংলাদেশের হাতে এসেছে।
আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি, তাই ভর্তুকির দাবি
ডিএমটিসিএল ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ জানান, এমআরটি লাইন-৬ চালুর পর প্রকল্পটির পরিচালন ব্যয় বহন করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক চাপে পড়েছে। আয় তুলনায় অনেক কম হওয়ায় প্রকল্প পরিচালনায় সরকার ঘোষিত সিড মানি সময়মতো না পাওয়া তাদের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিড মানি বা প্রারম্ভিক ভর্তুকি না পেলে প্রকল্পের টেকসই পরিচালনা, নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ২২ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে সুদযুক্ত ঋণ হিসেবে ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় ডিএমটিসিএলকে। এরপর ২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর ডিএমটিসিএল অনুদান হিসেবে অবশিষ্ট ৮৫০ কোটি টাকার বরাদ্দ অনুমোদনের প্রস্তাব সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে পাঠায়। এই প্রস্তাব যাচাই-বাছাইয়ের পর ২১ ডিসেম্বর ডিএমটিসিএলের ৫৬তম পরিচালনা পর্ষদ সভায় তা অনুমোদিত হয়।
পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের বিষয়টি ২০২৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে অবগত করা হয়। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ১৯ মার্চ এমআরটি লাইন-৬-এর বাণিজ্যিক পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণ ও অবচয় ব্যয় নির্বাহের নিমিত্তে অনুদান হিসেবে চাহিত অবশিষ্ট ৮৫০ কোটি টাকা সিড মানি হিসেবে বরাদ্দ প্রদানের জন্য প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পুনরায় পাঠানো হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় পার হলেও অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ ছাড়ের কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি।
মেট্রোরেলের অভ্যন্তরীণ আর্থিক চাপ বাড়ছে
ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা বলছেন, মেট্রোরেলের প্রতিদিনের পরিচালনা ব্যয়, বিদ্যুৎ বিল, জনবল বেতন, অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ, যন্ত্রপাতির অবচয় এবং নিরাপত্তা খাতে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। অথচ যাত্রীভাড়া থেকে আসা রাজস্ব এখনো এই ব্যয় পূরণে যথেষ্ট নয়। সরকারের প্রতিশ্রুত অনুদান পেলে প্রতিষ্ঠানটি কিছুটা স্বস্তি পেত এবং দীর্ঘ মেয়াদে একটি পরিকল্পিত আর্থিক কাঠামো দাঁড় করানো সম্ভব হতো।
এমআরটি লাইন-৬-এর মূল লক্ষ্য ছিল রাজধানী ঢাকায় পরিবহন জট কমিয়ে নিরবচ্ছিন্ন গণপরিবহন সেবা নিশ্চিত করা। প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরু থেকেই সরকার এই উদ্যোগকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। তবে বাণিজ্যিক পরিচালনার ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা ঠিকভাবে না পেলে এই সেবার গুণগত মান ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সময়মতো বরাদ্দ না পেলে ব্যাহত হবে পরিচালনা
গণপরিবহন ও অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা বিশ্বের উন্নত শহরগুলোর মতো ঢাকায়ও মেট্রোরেলের মতো বিশাল পরিসরের পরিবহন ব্যবস্থায় প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা জরুরি। একদিকে মেট্রোরেল এখনো লাভজনক অবস্থানে পৌঁছায়নি, অন্যদিকে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনায় লাগামহীন খরচ রয়েছে।
এমন বাস্তবতায় প্রতিশ্রুত সিড মানি ছাড় না হওয়ায় প্রকল্প পরিচালনায় মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। তারা আরও বলেন, সরকার যদি সময়মতো এই অনুদান না দেয়, তাহলে ভবিষ্যতে মেট্রোরেলের সেবা ব্যাহত হওয়া, রক্ষণাবেক্ষণ ফাঁকফোকরে যাওয়া এবং যাত্রীদের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
ডিএমটিসিএলের পক্ষ থেকে আবারও অনুরোধ
ডিএমটিসিএলের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগে পুনরায় অনুরোধ জানানো হয়েছে, এমআরটি লাইন-৬ পরিচালনার জন্য অনুদান হিসেবে চাহিত ৮৫০ কোটি টাকা সিড মানি এককালীন বরাদ্দ প্রদান করা হোক। তারা উল্লেখ করেছে, এই বরাদ্দ দ্রুত অনুমোদিত হলে সরকারের পরিবহন খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি নিরাপদ, সুষ্ঠু ও টেকসইভাবে পরিচালিত হতে পারবে।
দেশে আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব গণপরিবহনব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করা মেট্রোরেল এখনো সরকারি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। ঘোষিত বরাদ্দের টাকা সময়মতো না ছাড়ানো হলে মেট্রোরেল ব্যবস্থাপনার ধারাবাহিকতা হুমকির মুখে পড়তে পারে এমন আশঙ্কাই এখন প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের।
টিকিট বিক্রি করে আয়
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শুধু টিকিট বিক্রি করে প্রায় ২৪৪ কোটি টাকা আয় করেছে বিদ্যুচ্চালিত মেট্রোরেল। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয় করেছে ১৮ কোটি টাকা। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে টিকিট বিক্রি বাবদ ২৪৩ কোটি ৯১ লাখ ৭ হাজার ৬২৫ টাকা আয় হয়েছে। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৮ কোটি ২৮ লাখ ৬ হাজার ৫১৪ টাকা।
সে হিসাবে মাসিক গড় আয় প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা। প্রতি মাসে ব্যয় হচ্ছে ১২ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৬ কোটি টাকা বিদ্যুৎ খরচ। আরও প্রায় ৬ কোটি খরচ আছে বেতন বাবদ। এটি ক্যাবল অপারেশনাল কাজের আংশিক ব্যয়। এর বাইরে মেরামত ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটা, ঋণের টাকা সুদসহ পরিশোধ, ডিএমটিসিএলের বিভিন্ন খরচ হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে।
সব মিলিয়ে মেট্রোরেলের আনুমানিক খরচ ৪০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে আয়ের থেকে ব্যয় বেশি। ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ আয় হতে পারে পুরোপুরি ট্রেন চললে। এখনো সেই পর্যায়ে যায়নি।
উত্তরা থেকে মতিঝিল ১৬টি স্টেশন
জানা গেছে, মেট্রোরেল উদ্বোধনের সাত বছর পর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পৌনে বারো কিলোমিটার লাইনের উদ্বোধন করা হয় ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর। ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর উদ্বোধন হয় উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত লাইনের।
বর্তমানে শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৭টা ১০ মিনিট থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত উত্তরা উত্তর থেকে মতিঝিল এবং সকাল ৭টা ৩০ মিনিট থেকে রাত ৯টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত মতিঝিল থেকে উত্তরা উত্তর রুটে নির্ধারিত হেডওয়ে অনুযায়ী মেট্রো ট্রেন বাণিজ্যিকভাবে চলাচল করছে। উত্তরা উত্তর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৬টি স্টেশনে থেমে ৩৩.৩৬ মিনিট সময় লাগে পৌঁছাতে।
ডিএমটিসিএলের তথ্যানুযায়ী, মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১.১৬ কিলোমিটার অংশের কাজ চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে সেটা কঠিন। চুক্তির সময় থেকে অন্তত ১০ মাসের মতো সময় লাগবে। প্রতিদিন গড়ে আড়াই থেকে ৩ লাখ যাত্রী চলাচল করে। ৬ কোচবিশিষ্ট ২৪ সেট মেট্রো যাত্রী পরিবহন করছে।
আপনার মতামত লিখুন :