নব্বইয়ের দশক ও এর পরবর্তী সময়ে সিলেট বিএনপি-ছাত্রদলে ছিল দুটি আলোচিত মুখ। তারা যেমন দলের ভেতরে প্রচ- রকম প্রভাবশালী ছিলেন, তেমনি ছিলেন সিলেট ছাত্রদলের কান্ডারিও। দুজনই বিএনপিতে এসেছিলেন ছাত্রদল থেকে। দুজনের কেউই এখন বিএনপিতে নেই। একজন নিখোঁজ, বিএনপির স্মৃতির পাতায় জ্বলজ্বল করছেন। তিনি এম ইলিয়াস আলী। ছিলেন সিলেট বিএনপির সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা। আরেকজন অ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান জামান। সিলেটের রাজনীতির আলোচিত ‘জামান’।
এরা বিএনপির সেই দুই নেতা, যাদের নামে একসময় সিলেটে বাঘে-হরিণে এক ঘাটে পানি খেত। তাদের মধ্যে সখ্য ছিল গভীর। একসময় একে অন্যের পরিপূরক ছিলেন। ইলিয়াস গুম হওয়ার পর তিনিই প্রথম গঠন করেছিলেন ‘ইলিয়াস মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ’। সিলেটে করেছেন দুর্বার আন্দোলন। ইলিয়াসের গুমের পর থেকে তার ওপর দলীয়ভাবে অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা বয়ে গেছে। তিনি টিকে গেছেন বটবৃক্ষের মতো।
এম ইলিয়াস আলী গুম বা নিখোঁজ হওয়ার পর রাজনীতির মাঠ থেকে হারিয়ে গেছেন। তিনি বেঁচে আছেন নাকি নেই, তা নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। বিএনপি এখন তার স্মৃতি নিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে ওঠে। অ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান জামান বিএনপি থেকে চলে গিয়েছিলেন স্বেচ্ছা-নির্বাসনে। বড্ড অভিমান নিয়ে তিনি যখন বিএনপির রাজনীতি থেকে বিশ্রাম নেন, তখন বেশ সংকটে পড়েছিল দলটি। সিলেট বিএনপির যে শক্তি, তার অর্ধেক ছিলেন তিনি। তিনি স্বেচ্ছা-অবসরে যাওয়ার পর শক্তির দিক থেকে সিলেট বিএনপি অনেকটাই পিছিয়ে যায়। তাকে ফেরানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। গেল ২০২২ সালের ১৯ নভেম্বর সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে বিএনপির সর্বশেষ সমাবেশের সময় তাকে দলে ফেরানোর একটি চেষ্টা হয়েছিল দল থেকেই। তখনো তিনি ছিলেন অভিমানে। ফিরবেন না বলে চলে গিয়েছিলেন লন্ডনে।
জামান যখন দল থেকে বের হন, তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। চারদিকে তার শত্রুরা ওত পেতে আছে। অসংখ্য মামলায় কাবু। তিনি সিলেট বিএনপির অনেক নেতার পথের কাঁটা। এম ইলিয়াস আলী নিখোঁজের পর যারা মনে মনে আনন্দিত হয়েছিলেন, তারা চাইছিলেন জামান যেন বিএনপিতে না থাকেন। কোনোভাবে যদি তাকে সরানো যায়। কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক এবং সিলেটের স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি পদে তখন। স্বেচ্ছাসেবক দলের হলেও প্রভাব রাখতেন বিএনপি ও ছাত্রদলে।
ঠিক সেই সময় তিনি সরে গেলেন দল থেকে। তাকে অবজ্ঞা করে, পাশ কাটিয়ে দেওয়া হয় সিলেট স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি। সেখানে পুরো কমিটিতে দু-একজন ছাড়া তিনি কিংবা তার অন্য সিনিয়র অনুসারীদের কাউকেই জায়গা দেওয়া হয়নি। সেই ক্ষোভ তিনি ঢাকাকে জানিয়েছিলেন, তাতে কর্ণপাত না করায় ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট ক্ষোভে দল থেকে ঘোষণা দিয়ে অবসরে যান। তখন বিএনপির রাজনীতি করায় তার কাঁধে ঝুলছিল ৩০টিও বেশি রাজনৈতিক মামলা। ছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘শুট আউট’ অর্ডারের মুখে। পরে সব তিনি সামলে নেন।
সেই অভিমান জামান বেশিদিন অবশ্য ধরে রাখতে পারেননি। দলে না থাকলেও, বাইরে থেকে তিনি দলের হয়ে কাজ করেছেন গোপনে। ‘বাংলাদেশ সলিডারিটি মুভমেন্ট’ নামে সংগঠন করে মূলত তার অনুসারী বিএনপি-ছাত্রদলের সহায়ক একটি বলয় তৈরি করেন। এই মুভমেন্টে দলের পদবঞ্চিত, অবহেলিত এবং যারা জামানকে অনুসরণ করেন তারা এসে যোগ দেন। এর কর্মী হাজার হাজার। তাদের মধ্যে শিক্ষার্থীও রয়েছেন।
দীর্ঘদিন জামান নীরবে থাকলেও সরকারের ফ্যাসিস্ট আচরণবিরোধী জনমত গঠনে কাজ করেন। তবে আলোচনায় সামনে আসেন ৫ আগস্টের আগে। বিএনপির আন্দোলনের সহায়ক শক্তি হিসেবে সিলেটে আভির্ভূত হয় তার সংগঠন। তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে সিলেটে যে বিপ্লব হয়ে যায়, তার পেছনে শক্ত ভূমিকা ছিল অ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান জামানের। তিনি রাজপথে, সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন টিলাগড়, শিবগঞ্জ, মিরাবাজার, চৌহাট্টাসহ নগরীর বিভিন্ন জায়গায়। প্রতিরোধ গড়ে তোলেন পুলিশি অ্যাকশনের বিরুদ্ধে। তখনই নীরবতা ভেঙে উঠে আসেন আলোচনার শীর্ষে।
আওয়ামী দুঃশাসন দূর হওয়ার পর তিনি মাঠে আরও বেশি সরব হয়ে ওঠেন। এখন ফিরতে চাইছেন দলে। আবার কাজ করতে চান বিএনপির জন্য। তবে এবার তার দলের সিলেটের অনেকেই চাইছেন না তিনি ফিরে আসুন। প্রকাশ্যে কেউ কিছু না বললেও বেশিসংখ্যক নেতাই চান না তিনি দলে ফিরুন। তবে জামানের শুভাকাক্সক্ষী ও বিএনপির ত্যাগী নেতারা চান, জামান ফিরে আসুন। তার দলে ফেরা সিলেটে আবারও বিএনপিকে তার হারানো গৌরবোজ্জ্বল সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। আওয়ামী লীগবিহীন আগামী সংসদ নির্বাচন অনেকটা সহজ মনে হলেও দলের জন্য সহজ নয়, কঠিন চ্যালেঞ্জ মোবাবিলা করতে হবে।
সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জামানের মতো পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতার প্রয়োজন রয়েছে সিলেট বিএনপিতেÑ এমনটাই মনে করেন বিএনপি ও ছাত্রদলের সাবেক অনেক দায়িত্বশীল নেতা। তারা মনে করেন, জামান বিএনপিরই কর্মী। বিএনপি দিয়ে রাজনীতিতে জন্ম, অভিমান করে রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও আর কোথাও যাননি। অনেক হাতছানি ছিল, তবে দলের সাথে, বিশ্বাসের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। ফলে বাইরে গিয়েও বিএনপির কর্মী হিসেবেই থেকে গিয়েছেন।
জামান দলে ফিরে এবার সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে প্রার্থী হওয়ার আশাবাদী। ইতিমধ্যে সেই প্রত্যাশা জানিয়ে মাঠে-ময়দান চষেও বেড়াচ্ছেন তিনি। অতীতের মতো এবারও তিনি সিলেট-৪ (জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ) আসনে প্রার্থী হতে চান। ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই আসনেই তিনি ছিলেন বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী। মনোনয়নও পেয়েছিলেন। সাবেক এমপি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ায় পেয়েছিলেন দলের কাছে অগ্রাধিকার। পরবর্তী সময়ে মরহুম দিলদার হোসেন সেলিম হন সেই আসনের প্রার্থী।
এবার দিলদার হোসেন সেলিমের অনুপস্থিতিতে সেই আসনে প্রার্থী হতে চান বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী, মহানগর বিএনপির প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম। এক বছর ধরে তারা এই আসনে প্রার্থিতার জন্য ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা করছেন। এর আগে এখান থেকে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। পরে অজ্ঞাত কারণে তিনি নিজেকে এই আসন থেকে সরিয়ে নেন। এখান থেকেই প্রার্থিতার আগ্রহ দেখাচ্ছেন সিলেট বিএনপির আলোচিত চরিত্র অ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান জামান।
তিনি চষে বেড়াচ্ছেন নির্বাচনি এলাকার এ-পাশ থেকে ও-পাশ। তাকে ঘিরে পুরো আসনে শুরু হয়েছে নতুন আলোচনা। হিসাব-নিকাশ চলছে নতুন করে। জৈন্তাপুর, গোয়ানঘাটজুড়ে নতুন আলোচনা তৈরি হয়েছে। জনসংযোগে তিনি তৃণমূল নেতাকর্মী এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে কুশল বিনিময় করেছেন। জনসংযোগে ব্যস্ত থাকছেন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি। গতকাল শুক্রবার বিকেলেও তিনি নির্বাচনি কার্যক্রম চালান। এর আগে জুমার নামাজ আদায় করেন সিলেটের হযরত শাহজালাল (রহ.) দরগাহ মসজিদে। তাকে ঘিরে পুরো সিলেট বিএনপিতে চলছে আলোচনা। ‘জামান ফিরছেন’Ñ এই মেসেজে দলের অনেকেই আবার প্রাণ ফিরে পাচ্ছেন।
দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সাথে আলাপকালে অ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান জামান বলেন, আমি দলের পরীক্ষিত কর্মী। দুর্দিনে ছিলাম। আঘাত পেয়ে মাঝখানে সামান্য সময়ের জন্য অবসরে ছিলাম। এটিকে দলত্যাগ বলা যাবে না। ত্যাগ করলে আমি অন্য দলে চলে যেতাম। সে রকম অফারও ছিল। কিন্তু আমি বিএনপির। এ কথা ভুলি না কখনোই। এখনো বিএনপিরই আছি। আগামীতেও থাকব।
তিনি বলেন, আমি দলে ফিরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহী। গত নির্বাচনে বিএনপির প্রতীকেই প্রার্থী হতে চেয়েছিলাম। দল আমার ওপর আস্থা রেখেছিল। পরবর্তী সময়ে দলের সিনিয়র সদস্য সেলিম ভাইকে সম্মান দেখাতে হয়েছে। আমার সুযোগ ছিল বিদ্রোহী হওয়ার। হইনি। দলকে আমি ভালোবাসি।
তার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলাম। এবারও মনোনয়ন চাইব সিলেট-৪ আসনে। দল মনোনয়ন দিলে আমি ধানের শীষের প্রার্থী হতে চাই। তবে দল যদি আমাকে মনোনয়ন না দেয়, আমি এবারও বিদ্রোহী প্রার্থী হব না। দলের যেকোনো সিদ্ধান্ত আমি মেনে নেব। আমাকে না দিলে দল যাকে দেবে তার হয়ে কাজ করব।
সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, দলের কেউ না হয়ে মনোনয়ন চাওয়ার সুযোগ নেই। দলের মনোনয়ন চাইতে হলে আগে তাকে দলে ফিরতে হবে। তিনি দলে ফিরবেন না তাকে দলে নেওয়া হবেÑ সেটি হাইকমান্ডের বিষয়। হাইকমান্ডই তার অতীত এবং বর্তমান কর্মকা- দেখে সিদ্ধান্ত নেবে। হাইকমান্ড তার ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নেবে সিলেট বিএনপি তাকে স্বাগত জানাবে। দলে ফেরার পরে যদি তিনি মনোনয়ন চান আর দল তাকে মনোনয়ন দেয়, তখন দল তার সাথে থাকবে। তার আগে দলের কোনো নেতাকর্মী তার হয়ে নির্বাচনি কাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে এই জার্নি অনেক দূরের পথ।