ঢাকা সোমবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৫

ইকো রিসোর্টে বদল উপকূলের অর্থনীতি

সৈকত মন্ডল, বাগেরহাট
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৭, ২০২৫, ০১:১১ এএম

শীতের মৌসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে বাড়ছে দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড়। বাগেরহাটের মোংলা, করমজল, হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর ও হারবাড়িয়া ইকোটুরিজম সেন্টার এখন প্রতিদিনই ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণে মুখর। বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় শীতে পর্যটকের সংখ্যা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বদলে যাচ্ছে সুন্দরবনকেন্দ্রিক উপকূলীয় এলাকার গ্রামীণ অর্থনীতি।

আগে মানসম্মত আবাসন না থাকায় অনেক পর্যটক সুন্দরবনে ঘুরে সেদিনই ফিরে যেতে বাধ্য হতেন। নিরাপদ ও আরামদায়ক রাত্রিযাপনের অভাব ছিল বড় প্রতিবন্ধকতা। তবে গত কয়েক বছরে এই চিত্র বদলে গেছে ব্যাপকভাবে। সুন্দরবনের আশপাশে নদী-উপকূলীয় এলাকায় গড়ে উঠেছে আধুনিক, পরিবেশবান্ধব একাধিক ইকো রিসোর্ট। এতে পর্যটকদের জন্য থাকার সুযোগ বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে তাদের আগ্রহও। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন হাজারো মানুষ আসছেন সুন্দরবনের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে। শীত এলেই এখানে তৈরি হয় উৎসবের আমেজ।

পর্যটনের উদ্যোগ বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে কর্মসংস্থান ও স্থানীয় আয়ের উৎস। স্থানীয় মানুষের ঘরের কাছেই তৈরি হয়েছে রোজগারের সুযোগ। ইকো রিসোর্ট, নৌযান, গাইড, পরিবহন, খাদ্য সরবরাহসহ নানা খাতে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে তৈরি হয়েছে প্রায় ৩ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান।

ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক বাবুল আহমেদ বলেন, ‘সুন্দরবনে এসে আমরা এখন নিরাপদে রাতযাপন করতে পারি। ইকো রিসোর্টের কারণে খুব কাছ থেকে সুন্দরবনের প্রকৃতি উপভোগের সুযোগ হচ্ছে, যা আগে সম্ভব ছিল না। পরিবার নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরতে পারছি।’

স্থানীয় বাসিন্দা দেবাশীষ ম-ল বলেন, ‘একসময় সুন্দরবনে প্রবেশ করাই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, তবু জীবিকার জন্য যেতে হতো। এখন পর্যটন বাড়ায় কাজের সুযোগও বেড়েছে। ঘরের কাছেই আয় হচ্ছে, ফলে গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থাও অনেক উন্নত হয়েছে।’

সুন্দরী ইকো রিসোর্টের পরিচালক মো. শরীফ বলেন, ‘সুন্দরবনকেন্দ্রিক এই ইকো রিসোর্টগুলো এখন উপকূলীয় অর্থনীতির বড় ভরসা। রিসোর্টগুলোয় সরাসরি ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৩ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। কেউ রিসোর্টে কাজ করছেন, কেউ গাইড, নৌকাচালক বা পরিবহনশ্রমিক হিসেবে যুক্ত হয়েছেন। এতে স্থানীয় বাজারে বেচাকেনা বেড়েছে, অর্থচক্রের গতি বেড়েছে বহুগুণ।’

তিনি আরও বলেন, ‘শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেও আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে থাকি। রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ নিয়মিত উপকূলীয় মানুষের জন্য ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প আয়োজন, ওষুধ বিতরণসহ নানা সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিছুদিন আগে সুন্দরী রিসোর্টের পক্ষ থেকে ১৬ হাজার উপকূলবাসীকে নিয়ে বৃহৎ ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প আয়োজন করা হয়েছিল। এসব উদ্যোগ আমাদের এলাকার মানুষের জন্য বড় সহায়তা হয়ে উঠছে।’

তবে এ উন্নয়নের পাশাপাশি রয়েছে উদ্বেগও। পূর্ব সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, ‘শীতের শুরুতেই পর্যটকের আনাগোনা বাড়ে। এই সুযোগে রিসোর্টের সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। তবে দুঃখের বিষয়, অনেক রিসোর্টই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে। এখনই সঠিক পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ না করা হলে ভবিষ্যতে এসব স্থাপনাই সুন্দরবনের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।’

পর্যটনের বিকাশে যেমন বদলে যাচ্ছে উপকূলীয় জনজীবন ও অর্থনীতি, তেমনি সুন্দরবন রক্ষায় প্রয়োজন সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনাÑ এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।