ঢাকা সোমবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৫

মৃত্তিকা ইনস্টিটিউটের রিপোর্ট

উত্তরের জমির উর্বরতা কমাচ্ছে রাসায়নিক সার

রেজাউল করিম, রংপুর 
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৪, ২০২৫, ০১:২৩ এএম

দেশের উত্তরের জেলাগুলোতে আশঙ্কাজনকভাবে জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বেড়েছে। এতে মাটির উর্বরা শক্তি কমে বাড়ছে অম্লত্বের হার। সর্বনি¤œ অবস্থায় রয়েছে জৈব পদার্থের উপস্থিতি। ফলে ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে মাটিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার হলেও তা ফসল উৎপাদনে কাজে লাগছে না। আমদানিকৃত বিপুল পরিমাণ সারেরও আর্থিক অপচয় হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

রংপুর বিভাগীয় মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট কার্যালয়ের গবেষণা রিপোর্ট থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, রংপুর বিভাগের ৮ জেলার মাটির উর্বরা শক্তি ক্রমাগত নষ্ট হয়ে মাটি ভারসাম্য হারাচ্ছে। এর ফলে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা ক্রমাগত নি¤œগামী হচ্ছে।

মৃত্তিকা গবেষকদের মতে, এতে কৃষক জমিতে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করেও কাক্সিক্ষত মাত্রায় তার ফসলের ফলন পাচ্ছে না। বেড়ে যাচ্ছে ফসল উৎপাদন ব্যয়। শুধু তাই নয়, মাটির উর্বরা শক্তি নষ্ট হচ্ছে। মাটিতে মিশে থাকা ফসল উৎপাদনের অনুজীবগুলোও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এতে কৃষি ব্যবস্থায় মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে বলে আশঙ্কা গবেষকদের।

ঢাকায় কৃষি খামারবাড়ি সড়কে মৃত্তিকা ভবনে স্থাপিত মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের কেন্দ্রীয় মাটি পরীক্ষা গবেষণাগারসহ দেশে বর্তমান ৩৯টি মাটি পরীক্ষা গবেষণাগার রয়েছে। এছাড়া বেশ কিছু ভ্রাম্যমাণ মৃক্তিকা গবেষণাগার রয়েছে। এসব গবেষণাগারের তথ্যমতে, শুধু রংপুর-রাজশাহী বিভাগের ১৬ জেলা নয়। এই মাটির উর্বরা শক্তির (গঠন প্রণালিতে মিশ্রিত জৈব, খনিজসহ অন্যান্য উপাদান) উপস্থিতি সর্বনি¤œ উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। এসব গবেষণাগারে মাটি পরীক্ষার সারা দেশের চিত্র বেশ উদ্বেগজনক বলে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইস্টিটিউটের রংপুর বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানিয়েছে।

এ অবস্থার পরিবর্তন করা না গেলে দেশের কৃষিব্যবস্থার জন্য অশনি সংকেত বলে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা মনে করছেন। এজন্য মাটিতে সুষম সার ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। এজন্য ব্যাপক প্রচারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন মাটি গবেষকরা।

দেশের প্রত্যন্ত জেলা উপজেলা থেকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাটি সংগ্রহ করে গবেষণগারে পরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চল ও উপজেলাভিত্তিক মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ‘ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদ ব্যবহারের নির্দেশিকা’ বই প্রকাশ করে আসছে। রংপুর বিভাগের ৫ জেলার ৩৮টি উপজেলা থেকে সংগৃহীত মাটি পরীক্ষা করে রংপুর মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা মাটির এ পরিস্থিতি পরিলক্ষিত করেন।

রংপুর বিভাগীয় মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের গবেষক দল যে মাটি পরীক্ষায় দেখছেন, দেশের কৃষি উপযোগী মাটির মারাত্মক রাসায়নিক ও জৈবিক গুণগত পরিবর্তন ঘটছে। এর ফলে মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে, গঠন প্রণালি ভেঙে যাচ্ছে এবং ফসল উৎপাদনের জন্য উর্বরা শক্তি ও ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ভূমি ক্ষয় প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে।

মাঠে অধিক ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ, উৎপাদন কমে যাওয়া, ধান গাছে চিটাসহ নানা প্রকার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে কৃষকের উৎপাদিত ফসলে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. সাইফুর রহমান জানিয়েছেন, মাটিতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম, গন্ধক, দস্তা, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, বোরন, মলিবডেনাম, লৌহ, ম্যাগানিজ, তামা, ক্লোরিন ও জৈব উপাদানসমূহ সঠিক মাত্রায় থাকা দরকার। অর্থাৎ এসব উপাদান ফসল উৎপাদনের জন্য একান্ত অপরিহার্য। মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে এবং মাটির চাহিদা অনুপাতে কৃষকদের জমিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। তা হলে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে যেমন কৃষক সন্তোষজনক ফলাফল পাবেন, তেমনি অনুমাননির্ভর সার প্রয়োগের ফলে মাটির গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে এবং ফসল উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। এ চিত্র শুধু উত্তরের জেলাগুলোতে নয়, এমন আশঙ্কাজনক মাটির পরিস্থিতির চিত্র সারা দেশের।

রংপুর বিভাগের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অতিরিক্ত পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে অন্তত ২০ প্রকার রাসায়নিক সার বৈধ ও অবৈধভাবে আসছে এবং কৃষিকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে কৃষকরা ৭টি রাসায়নিক সারের সঙ্গে বেশি পরিচিত। এসব সার কৃষকরা অনুমাননির্ভর ব্যবহার করে থাকেন। তাই আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না।’

এই কৃষিবিদ আরও জানান, রংপুর ও রাজশাহী বরেন্দ্র অঞ্চলসহ বিভাগ শুধু নয়, দেশের অন্যান্য নদী অববাহিকা অঞ্চলের জেলাগুলোতেও একই পরিস্থিতি বিদ্যমান।

মাটি পরীক্ষার গবেষণা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যে ৯ ধরনের উপাদন মাটিতে সর্বনি¤œ পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, মাটিতে অন্তত পক্ষে জৈব পদার্থের উপস্থিতি থাকা প্রয়োজন, শতকরা ৫ ভাগ, তা রয়েছে মাত্র শতকরা ১ থেকে ২ ভাগ। মাটিতে পিএইচ (অম্লত্ব) থাকা উচিত কম পক্ষে শতকরা ৬ থেকে সাড়ে ৭ ভাগ। সেখানে রয়েছে শতকরা দশমিক ৪ থেকে সাড়ে ৫ ভাগ। অম্লত্ব কমে গেলে মাটিতে অদ্রবণীয় অদৃশ্য আবরণ তৈরি হয়, ফলে বিশেষ করে টিএসপি (ফসফরাস) সার প্রয়োগ করলে তা উৎপাদিত ফসলের কাজে আসে না। যেখানে মাটিতে নাইট্রোজেন থাকা উচিত শতকরা শূন্য দশমিক ২৭ থেকে শূন্য দশমিক ৩৬ ভাগ, সেখানে রয়েছে মাত্র শতকরা দশমিক ০৯ থেকে শূন্য দশমিক ১৮ মাত্রা পর্যন্ত। একইভাবে সালফার থাকা প্রয়োজন শতকরা ২২ দশমিক শূন্য ৫ থেকে ৩০ পর্যন্ত। সেই মাত্রাও সর্ব নি¤œপর্যায়ে রয়েছে।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. সাইফুর রহমানের মতে, মাটিতে পোকা মাকড়ের জীবন চক্রের সঙ্গে অতিরিক্ত জৈব পদার্থ সংযুক্ত রয়েছে। যেমন- কেঁচো মাটি খেয়ে উপরের স্তরের মাটি নিচে ও নিচের স্তরের মাটি উপরে আনে; যা কৃষকের জন্য সুফল বয়ে আনে। বাংলাদেশে প্রায় ২০ প্রজাতির ব্যাঙ রয়েছে, কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ব্যাঙের বংশ বৃদ্ধি কমেছে।

এই কর্মকর্তার মতে, কৃষিজমির মাটি পরীক্ষা করে প্রয়োজন অনুপাতে সার ব্যবহারে কৃষকদের হাতেকলমে শিক্ষা দেওয়া জরুরি। এর ফলে দেশে রাসায়নিক সারের ঘাটতি মোকাবেলা করা সম্ভব।