ঢাকা শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৫

সিদ্ধিরগঞ্জে মসজিদ ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণের চেষ্টা, এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ

মো. সোহেল কিরণ, নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৮, ২০২৫, ০২:১০ এএম

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে প্রভাব খাটিয়ে ৩৩ বছরের পুরোনো ‘দারুস সালেহ জামে মসজিদ’ ভেঙে ফেলার অভিযোগ উঠেছে তথাকথিত বিএনপি নেতা শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে। মসজিদের জায়গায় অবৈধভাবে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের পাঁয়তারা চালাচ্ছেন গত বছরের ৫ আগস্টের পর ভোল্ট পাল্টানো সাবেক এই আওয়ামী লীগ নেতা।

মসজিদ ভাঙার ন্যক্কারজনক পাঁয়তারার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ধর্মপ্রাণ এলাকাবাসী।

মসজিদটি বাঁচাতে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়সহ বিভাগীয় কমিশনার, ওয়াকফ প্রশাসক, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন স্থানীয় মুসল্লি ও গ্রামবাসী। মসজিদ ভাঙার কাজ দ্রুত বন্ধ করা না হলে যেকোনো সময় এলাকায় ঘটতে পারে সংঘর্ষ। উদ্ভূত পরিস্তিতিতে আইনশৃঙ্খলার অবনতির দায় কে নেবে সেই প্রশ্নও উঠেছে।

সরেজমিনে জানা যায়, সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি-মৌচাক এলাকার আশপাশে কোনো মসজিদ না থাকায় স্থানীয়দের নামাজ আদায়ের জন্য অনেক দূরে যেতে হতো। এতে যথাসময়ে নামাজ আদায় করতে মুসল্লিদের অনেক কষ্ট হতো। বিষয়টি জানতে পেরে স্থানীয় শিল্পপতি হাজি মো. সালাহ উদ্দিন মিয়া ১৯৯২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জের খর্দ্দঘোষপাড়া মৌজার এসএ-১০৩ ও আরএস-৫৩০নং দাগে ৭ শতক জমি ২৪৩৭ ও ২৪৩৮নং দলিলমূলে জমি কিনে দ্বিতল মসজিদ নির্মাণ করে দেন। নির্মাণের পর থেকে মসজিদটিতে স্থানীয় মুসল্লিসহ পথচারীরা নামাজ আদায় করছেন। পরবর্তীতে ২০০২ সালের ৪ এপ্রিল ১৩৭১ ও ৭০১ দলিলমূলে জমির মালিক শিল্পপতি হাজি সালাহ উদ্দিন মিয়া জমিটি মসজিদের নামে ওয়াকফ করে দেন। ২০১৬ সালে হাজি সালাউদ্দিন মিয়ার মৃত্যুর পর তার সন্তানেরা মসজিদের আশপাশের অধিকাংশ জমি বিক্রি করে দেন। এখনো কিছু জমি রয়ে গেছে তাদের নামে। তবে তারা জমির কোনো খোঁজখবর রাখেন না। এ সুযোগে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে শহিদুল ইসলাম ও তার সহযোগীরা জাল দলিলের মাধ্যমে  ক্রয়সূত্রে মালিক দাবি করে মসজিদের জমি দখল করেন। বর্তমানে এই মসজিদটি ভেঙে বাণিজ্যিক বহুতল ভবন নির্মাণের পাঁয়তারা চালাচ্ছে এ নেতা।

স্থানীয় বাসিন্দা আবুল খায়ের এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ক্ষমতার প্রভাবে গত কয়েকদিন ধরে স্থানীয় শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে মসজিদটি ভাঙার কাজ চলছে। এটা অন্যায়। জীবন থাকতে আমরা এটা মেনে নেব না। আল্লাহর ঘর বাঁচাতে প্রয়োজনে জীবণ দেব তবুও এ অন্যায় মেনে নেব না।’

স্থানীয় সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা ইকবাল হোসেন বলেন, ‘মসজিদের জমিটি ওয়াকফকৃত। এটা ব্যক্তি মালিকানা জমি না। তিন যুগ ধরে এ মসজিদে এলাকার মুসল্লিরা নামাজ আদায় করছেন। মসজিদ ভাঙার খবর পেয়ে সরেজমিনে গিয়েছিলাম। মসজিদের জমি বাদে ভবন নির্মাণ করার কথা বলে আসছি। মসজিদের জমিতে ভবন নির্মাণ করতে দেওয়া হবে না।’

নজরুল ইসলাম ও দুলাল মিয়া নামে দুই এলাকাবাসী জানান, মসজিদ ভেঙে ফেলা হচ্ছে। সে জায়গায় নাকি বহুতল বাণিজ্যিক ভবন করা হবে। আমরা তা হতে দেব না। দ্রুত মসজিদের জায়গা ফেরত দিয়ে আমাদের মসজিদ নির্মাণ করে না দেওয়া হলে আমরা তার কঠোর জবাব দেব। প্রশাসনের কাছে দাবি জানাই দ্রুত এর ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

মসজিদের জমি প্রদানকারী মরহুম সালাউদ্দিন মিয়ার ছেলে জসিম মিয়া বলেন, ‘বহু বছর আগে আমার বাবা নিজ অর্থায়নে দ্বিতীয় তলা মসজিদ নির্মাণ করে দুটি দলিলে ৭ শতাংশ জমি ওয়াকফ করে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের দোসর শহিদুল ইসলামসহ সংঘবদ্ধ একটি ভূমিদস্যু চক্র মসজিদ ভেঙে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করার চেষ্টা করছে বলে জানতে পেরেছি। ব্যস্ততার কারণে আমি নিজে যেতে পারছি না। স্থানীয় কয়েকজন গণমান্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়েছি তারা যেন মসজিদের জমি রক্ষা করার উদ্যোগ নেন।’

স্থানীয় মারকাজুল আজিজ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজ বলেন, ওয়াকফকৃত জমিতে তিন যুগ আগে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর শহিদুল ইসলাম মসজিদের আশপাশের খালি জামিতে দোকানপাট নির্মাণ করে ভাড়া দিয়ে নিজেই ভাড়া নিতেন। মসজিদ ভাঙা শুরু করার পর প্রকৃত উদ্দেশ্য জানতে পেরে আমিসহ স্থানীয় লোকজন গিয়ে বাধা দেই। দোকানপাটের ভাড়া কোনো ব্যক্তি নয়, মসজিদের তহবিলে জমা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

স্থানীয় বাসিন্দা গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির গৃহায়ন ভূমি ও পুনর্বাসন সম্পাদক আবুল খায়ের শান্ত বলেন, ‘মসজিদ ভেঙে জমি দখল করে যারা বাণিজ্যিক ভবণ নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে তারা প্রকৃত মুসলমান হতে পারে না। শহিদুল ইসলামের পেটে এত খিদা যে, তিনি মসজিদের জমি দখল করে দোকানপাট নির্মাণ করে মাসে ৪৮ হাজার টাকা করে ভাড়া নিচ্ছেন। শুধু মসজিদের খালি জমি নয়, তিনি মসজিদ ভেঙে সব জমি গ্রাস করতে চান। একজন মুসলমান হিসেবে আমরা তা হতে দেব না।’

অভিযোগের বিষয়ে শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ক্রয়সূত্রে এ জমির মালিক। এখানে একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে। তবে নিচ ও দ্বিতীয় তলাটি মসজিদ হিসেবেই থাকবে। মসজিদের দেখাশোনা আমিই করব।’

সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি শাহিনূর আলম বলেন, ‘মসজিদ ভেঙে ফেলার বিষয়ে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে অভিযোগ করতে এসেছিল। তখন অন্য পক্ষও থানা আসেন। এ সময় উভয় পক্ষ আমার কাছে আসলে স্থানীয়ভাবে মিলে মসজিদ উন্নয়নের জন্য কাজ করতে বলে দিয়েছি।’

বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসক (যুগ্ম সচিব) নূর-ই-আলম ও উপ প্রশাসক (উপসচিব) মো. মেহেদী হাসানের ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করেও তাদের পাওয়া যায়নি।