কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের ব্লক ম্যানেজার কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী সেচের পানি সরবরাহ করেন না। ফলে কৃষকের বোরো ধান আবাদে পানিসংকট থেকে যায়। তাই ওই ব্লকে ফসলের উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। এ ব্লক থেকে সরকার বছরে মাত্র ৫ হাজার টাকা ভাড়া পায়। আর ব্লক ম্যানেজারের পকেটে যায় লক্ষাধিক টাকা। এর মধ্যে সেচের পানির দাম দ্বিগুণ করার দাবি করেছেন ব্লক ম্যানেজার। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কৃষকরা উপজেলা বিএডিসির সহকারী প্রকৌশলী বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন।
এমন ঘটনা ঘটেছে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার কুশলী ইউনিয়নে। অভিযুক্ত আবু বক্কর লস্কর কুশলী লস্করপাড়া ২ কিউসেক এলএলপি সেচ স্কিম ব্লকের ম্যানেজার ও একই গ্রামের বাবু লস্করের ছেলে।
গত বৃহস্পতিবার ওই ব্লক ম্যানেজারের বিরুদ্ধে টুঙ্গিপাড়া কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের সহকারী প্রকৌশলী বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন ওই গ্রামের ৩২ জন কৃষক।
লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, ১২ বছর ধরে কুশলী ইউনিয়নের লস্করপাড়া বিএডিসি ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প পরিচালনা করে আসছেন ব্লক ম্যানেজার আবু বক্কর লস্কর। বিগত ৭ বছর ধরে তিনি এ ব্লকের বোরো ধানের জমিতে চাহিদা অনুযায়ী পানি সরবরাহ করছেন না। পানি সরবরাহ নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি কৃষকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের কাছে একাধিকবার মৌখিক অভিযোগ করলেও কৃষকেরা কোনো প্রতিকার পাননি। এ ছাড়া এত বছর ধরে সেচের পানি বাবদ কৃষকপ্রতি ২ হাজার ৫০০ টাকা আদায় করা হচ্ছিল। কিন্তু এ বছর কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) সেচ পানির দাম কৃষকপ্রতি ৫ হাজার টাকা ধার্য করেছে বলে ব্লক ম্যানেজার কৃষকদের জানিয়েছেন। এ অবস্থায় পানির দাম দ্বিগুণ করা হলে কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়বেন।
টুঙ্গিপাড়া বিএডিসি ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে কুশলী লস্করপাড়া ২ কিউসেক এলএলপি সেচ স্কিম স্থাপন করা হয়। এই সেচ স্কিমের আওতায় ১২ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করেন ওই গ্রামের ৬০ জন কৃষক। প্রকল্পে মোটর, ট্রান্সফরমার, পাম্প হাউস, বারিড পাইপলাইন ভাড়া বাবদ বাৎসরিক মোট ৫ হাজার টাকা বিএডিসিতে জমা দেন ম্যানেজার আবু বক্কর।
কুশলী ইউনিয়নের লস্করপাড়া গ্রামের কৃষক মুজাহিদ লস্কর বলেন, ম্যানেজার আবু বক্কর লস্কর চাহিদার অর্ধেক পানিও সরবরাহ করেন না। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। কেউ প্রতিবাদ করলেই তার জমিতে পানি দেওয়া বন্ধ করে দেন। এতে এ ব্লকে ফসলের উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এ ছাড়া এত বছর ধরে ব্লক ম্যানেজার আবু বক্করকে বছরে ২ হাজার ৫শ’ টাকা করে দিতাম। এ বছর বিএডিসির দোহাই দিয়ে পানির দাম ৫ হাজার টাকা চেয়েছেন। আর টাকা না দিতে পারলে জমিতে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার হুঁমকি দিয়েছেন।
লস্করপাড়া ব্লকের কৃষক সোহেল লস্কর, জামাল ফরাজী বলেন, ম্যানেজার আবু বক্করের গাফিলতির কারণে ঠিকমতো জমিতে পানি দিতে পারি না। তাই প্রতিবছর আমাদের ধানের ফলন কমে যাচ্ছে। আগে বিঘাপ্রতি ৪০-৪৫ মণ হাইব্রিড ধান পেতাম। এখন উৎপাদন হয় ২২ থেকে ২৫ মণ। ম্যানেজারের বিরুদ্ধে আগে একাধিকবার বিএডিসির অফিসারদের কাছে মৌখিক অভিযোগ করেছি। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি। তাই কৃষির স্বার্থে আমরা ম্যানেজারের অপসারণ চাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কৃষক বলেন, আবু বক্কর ও কিছু ক্ষমতাশালী ব্যক্তি এ টাকার ভাগ খান। আর এর সাথে বিএডিসির অফিসারদের যোগসাজশ থাকতে পারে। না হলে ম্যানেজার পরিবর্তন করতে অফিসারদের এত আপত্তি কোথায়! দ্রুত ম্যানেজার পরিবর্তন না করলে কৃষকের লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে ফসল ফলানো ছেড়ে দেবে।
কুশলী লস্করপাড়া ব্লকের সভাপতি আফজাল লস্কর বলেন, ওখানে আমাদের জমি থাকায় আমাকে সভাপতি দিয়ে রেখেছে। কিন্তু আয়-ব্যয়ের হিসাব ম্যানেজার আবু বক্কর কখনো দেয় না। আর কী খরচ যায় তা-ও জানি না।
অভিযোগকারীদের এ ব্লকে জমি নেই দাবি করে ব্লক ম্যানেজার আবু বক্কর বলেন, বোরো মৌসুমে পৌষ থেকে চৈত্র পর্যন্ত ৪ মাস ব্লক চলে। প্রতিবছর ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়। ব্লকের ট্রান্সফরমার, বারিড পাইপ, পাম্প বা অন্যান্য উপকরণ মেরামতে কোনো টাকা বিএডিসি দেয় না। এটি আমাকে মেরামত করে নিতে হয়। এ ছাড়া পাম্প চালাতে শ্রম ও সময় দিতে হয়। কৃষকরা ঠিকমতো টাকা দেয় না। এ ব্লক চালিয়ে আমার লাভের টাকা থাকে না। গত ১২ বছরে সব কিছুর দাম বেড়েছে। তাই এ বছর সেচের পানির মূল্য বাড়িয়ে দিতে বলেছি।
তিনি কৃষকদের সাথে দুর্ব্যবহার করার কথা অস্বীকার করে বলেন, প্রতিবার পাম্প চালাতে ব্যাপক পরিশ্রম ও পানির প্রয়োজন হয়। এ কারণে মাঝে মাঝে সময়মতো পাম্প চালাতে পারিনি।
টুঙ্গিপাড়া কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ক্ষুদ্রসেচ প্রকল্পের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ব্লকের ম্যানেজারের বিরুদ্ধে কৃষকদের লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। সরজমিনে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া ব্লকের পাম্প ট্রান্সফরমার, বারিড পাইপে সমস্যা হলে আমরা সরকারি খরচে মেরামত করে দিই। কিন্তু চুরি হলে এ দায়দায়িত্ব ব্লক ম্যানেজারকে বহন করতে হবে। আমার সেচ পানির দাম বাড়াতে বলিনি। ব্লক পরিচালনার জন্য কমিটি আছে। এ ব্যাপারে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এখানে পানির দাম বাড়ানো-কমানোতে আমাদের কোনো হাত নেই। এমনকি ম্যানেজারে সাথেও আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

