স্বাস্থ্য খাত একটি দেশের জনগণের জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। এটি কেবল চিকিৎসাসেবা নয়, বরং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাত দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে কাক্সিক্ষত মানে পৌঁছাতে পারছে না।
প্রতিবছরই জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বড় অঙ্কের বরাদ্দ রাখা হয়, কিন্তু সেই অর্থের সদ্ব্যবহার হয় না। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ওষুধের ঘাটতি, ডাক্তার-নার্সের অনুপস্থিতি, যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা, ঠিকাদারি অনিয়ম এবং রোগীদের হয়রানি সব মিলিয়ে একটি সংকটজনক চিত্র ফুটে ওঠে। করোনা মহামারির সময় এ খাতের দুর্বলতা বিশেষভাবে চোখে পড়েছিল। যখন ভুয়া করোনা রিপোর্ট কেলেঙ্কারি, অক্সিজেন সংকট ও হাসপাতাল বাণিজ্যের বাস্তবতা সামনে চলে আসে।
সোমবার রূপালী বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে স্বাস্থ্য খাতের অনয়িম ও দুর্নীতির মূল হোতার গল্প। তার নাম সামিউল সাদী। প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের সময় দেশে জরুরি ভিত্তিতে ৮৮৯ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ১৮০০ জন মেডিকেল টেকনিশিয়ান নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন স্বাস্থ্য বিভাগ।
পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে চলে নিয়োগ কার্যক্রম। শুরুতে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন না উঠলেও ধীরে ধীরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তার কাছে এটি হয়ে ওঠে সোনার ডিম পাড়া হাঁস। এসব কর্মকর্তার মধ্যে অন্যতম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (প্রশাসন) ডা. শামিউল ইসলাম সাদী। বিভিন্ন সময় চাকরিপ্রত্যাশী প্রার্থীদের কাছ থেকে ঘুষ হিসেবে আদায় করেন কোটি কোটি টাকা। এক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিকে কেন্দ্র করেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠেন তিনি। সর্বশেষ ২০২৩ সালে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ৩০ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্টের কাছ থেকে ৮ লাখ করে মোট ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা নেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ কমিটির সদস্যসচিব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তখনকার উপ-পরিচালক (প্রশাসন) আ ফ ম আখতার হোসেনের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। যার অন্যতম অংশীদার ছিলেন ডা. সামিউল সাদী। যিনি চাকরি জীবনে বরাবরই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন। এই সিন্ডিকেটে তাদের সহযোগী হিসেবে কর্মচারীদের মধ্যে আরও ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (স্বাস্থ্য) সাবেক তত্ত্বাবধায়ক মহব্বত হোসেন খান, পরিচালক এমবিডিসি দপ্তরের সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আবদুল মমিন শেখসহ কয়েকজন।
বদলি, পদায়ন, পদোন্নতিসহ প্রশাসন শাখার নানা কর্মকা-ে তারাই করতেন তদবির বাণিজ্য। একই সঙ্গে সরকারি হাসপাতালের বরাদ্দ থেকে বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনাকাটায় ছিল তার হাত। ডা. সাদীর ওপর ছিল সরকারের উপরি মহলের আশীর্বাদ। আর এরই ফলে পদোন্নতি পেয়ে সামিউল হয়ে যান একই অধিদপ্তরের প্রশাসন বিভাগেরও পরিচালক। বদলি বাণিজ্য থেকে শুরু করে নিয়োগ বাণিজ্য- সব কিছুই হতো ডা. সাদীর ইশারায়।
স্বাস্থ্য খাতের এসব সামিউলদের রুখতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে মানুষের জীবন বাঁচানোর এই খাশ পরিণত হবে মৃত্যুর গ্যাঁড়াকলে।
এই অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। দুর্নীতিতে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। নিয়োগ, পদায়ন ও ওষুধ সরবরাহ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারি হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল নজরদারি চালু করতে হবে, যাতে সেবা গ্রহীতারা হয়রানির শিকার না হন।
স্বাস্থ্য একটি মৌলিক অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন সুশাসন, নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতা। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের আহ্বান, স্বাস্থ্য খাতকে অনিয়মমুক্ত করুন, যাতে দেশের প্রতিটি নাগরিক নিশ্চিত ও মানবিক সেবা পান। এটি শুধু উন্নয়নের অঙ্গীকার নয়, বরং একটি সভ্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সরকারকে মনে রাখতে হবে, উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে থাকলে এই অনিয়মের ঝড় কোনোদিনই থামবে না।