মানবতাবিরোধী অপরাধ কেবল একটি রাষ্ট্র বা সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বরং পুরো মানব জাতির বিরুদ্ধে সংঘটিত ভয়াবহ অপরাধ। গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও নির্বিচারে হত্যাকা-Ñ এসব অপরাধ সভ্যতার ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত এমন নৃশংস অপরাধের বিচার আজও চলছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের ঘটনায়ও মানবতাবিরোধী অপরাধে বেশ কয়েকজনের বিচার চলছে। এই প্রেক্ষাপটে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা একটি যুগোপযোগী ও ন্যায়সংগত সিদ্ধান্ত। এটি কেবল নির্বাচনি শুদ্ধতা নয়, এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এক দৃঢ় পদক্ষেপও বটে।
বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর সেকশন ২৩ যোগ করে স্পষ্ট করা হয়েছে, যদি কারও বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠন করা হয় (ফরমাল চার্জ দাখিল), তাহলে তিনি সংসদ সদস্য, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, প্রশাসক কিংবা সরকারি চাকরিতে বহাল থাকার যোগ্যতা হারাবেন। এই বিধান কেবল রাজনৈতিক ক্ষেত্র নয়, বরং রাষ্ট্রের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও অভিযুক্তদের পথ রুদ্ধ করবে।
যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত, তিনি জাতির মৌলিক মূল্যবোধের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নন। তিনি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার নৈতিক অধিকার হারান। এমনকি, আদালতে তার দোষ প্রমাণিত না হলেও, যদি অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক হওয়ার ক্ষেত্রে তার অবস্থান অগ্রহণযোগ্য হয়ে যায়।
গণতন্ত্র কেবল ভোটাধিকার নয়, এর সঙ্গে জড়িত থাকে নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচার, যারা মানবতার বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপরাধে জড়িত ছিলেন বা এখনো অভিযুক্ত, তাদের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার থাকা উচিত নয়। কেননা, জনগণের প্রতিনিধি মানেই জনগণের আস্থাভাজন, যিনি দেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করবেন। অপরাধের কলঙ্ক বহনকারীরা কোনোভাবেই জাতির নেতৃত্বে আসতে পারেন না।
নির্বাচন কমিশনের এমন প্রস্তাব গণতন্ত্রকে কলুষমুক্ত করতে সহায়ক হবে। এটি যেমন মুক্তিকামী জনতার চেতনার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্পষ্ট বার্তা দেয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই, কোনো বৈধতাও নেই। একই সঙ্গে এটি রাজনৈতিক দলগুলোকেও সতর্ক করবে, যাতে তারা এ ধরনের বিতর্কিত ব্যক্তিকে প্রার্থী না করে।
স্বভাবতই, এ ধরনের পদক্ষেপ কিছু মহলে বিতর্ক তৈরি করতে পারে। কারণ বিচারাধীন ব্যক্তি দোষী না-ও হতে পারেন। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ‘নৈতিক যোগ্যতা’ একটি পূর্বশর্ত, যা কেবল আইনি দৃষ্টিভঙ্গি নয়, নৈতিক অবস্থান থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
এ ছাড়া, এই সংশোধনী রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অপরাধমুক্ত করতে সহায়ক হবে এবং ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রার্থী নির্বাচনে অধিক সতর্ক করবে। একই সঙ্গে, নাগরিক সমাজের দীর্ঘদিনের একটি দাবি পূরণ হলো, যে দাবি ছিল যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ছায়ায় লুকাতে না পারে।
আমরা আশাবাদী, এই পদক্ষেপ ইতিহাস, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিকে আরও সুদৃঢ় করবে। তবে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, আইনের প্রয়োগ হবে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত নয়।
আমরা মনে করি, এই সিদ্ধান্ত কেবল আইন প্রণয়নের বিষয় নয়, এটি হচ্ছে ন্যায়, ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ। আমরা আশা করি, এর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে একটি ন্যায়কেন্দ্রিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন