বেশ কিছুদিন ধরেই লেখক-গবেষক-চিন্তক-শিক্ষাবিদ ও বামপন্থি রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমরকে নিয়ে উৎকণ্ঠা ছিল। এর বাইরেও তার আরও পরিচয় রয়েছে। তিনি ছিলেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতিও। শত বছর স্পর্শ করার আর মাত্র ৬ বছর বাকি ছিল। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে ফিরে ফিরে তার গন্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল হাসপাতাল। ৭ সেপ্টেম্বর সকাল প্রায় ১০টা ১৮ মিনিটে তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে হার মানেন জীবনযুদ্ধে। কিন্তু তাঁর সৃষ্টির সমৃদ্ধ ভা-ার আমাদের জন্য যে সম্পদ গড়েছে, তিনি এর মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে। ইতিহাস-গবেষণা তো বটেই, অন্যান্য রচনার মধ্য দিয়েও তিনি যে সৃজনের স্বাক্ষর রেখে গেছেনÑ অর্থাৎ তাঁর কর্মপ্রয়াস, যা আমাদের সামনে রয়েছে, এর কাছে আমাদের বারবার দ্বারস্থ হতেই হবে। তাই তাঁর প্রয়াণ ঘটলেও তাঁর কর্মের জন্যই তিনি আমাদের কাছে থাকবেন অমর।
মনীষাদীপ্ত এই কীর্তিমানের সঙ্গে পেশাগত প্রয়োজনে আমার সান্নিধ্য লাভের সুযোগ ঘটেছে। এই প্রেক্ষাপটে মানসপটে এই মুহূর্তে ভেসে উঠছে অনেক স্মৃতি। কিন্তু এই ব্যক্তিগত ও পেশাগত বিষয়গুলো আজ তাঁকে নিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন পর্বে থাকুক অনুচ্চারিতই। কারণ তিনি তো আজ সব কিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। তাঁর জীবনপঞ্জি কত পুষ্ট, এর খানিক পরিচয় মেলে এই তথ্যে। ১৯৫৫ সালে এমএ পাস করার পর ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে এবং ১৯৫৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিÑ এই তিন বিষয়ে অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।
তিনি ১৯৬১ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে পিপিই ডিগ্রি নিয়ে দেশে আসেন এবং ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। গভর্নর মোনায়েম খানের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে রাজনীতি ও লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর লেখা ‘পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম গবেষণাগ্রন্থই শুধু নয়, আমাদের ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ও বটে। বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারীও ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর সংগঠিত করেন বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের মঞ্চ বাংলাদেশ লেখক শিবির।
নাগরিক অধিকার রক্ষার যেকোনো উদ্যোগে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। শহিদ জননী জাহানারা ইমামের সঙ্গে গণ-আদালতেও যুক্ত ছিলেন। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে সম্পাদনা করেছেন মাসিক ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকা। একসময় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। ২০০৩ সালে তিনি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামে একটি সংগঠন গড়ে সভাপতির দায়িত্ব নেন। বদরুদ্দীন উমর-এর কর্ম খতিয়ান কত বিস্তৃত এরও সাক্ষ্য মেলে তাঁর জীবনপঞ্জির পরতে পরতে। দেশভাগের শিকার এই কীর্তিমান পশ্চিম বাংলা থেকে কৃষক সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তর-একাত্তর পেরিয়ে বাংলাদেশ অবধি অবিরাম চালিয়েছেন সৃজন আর সংগ্রামের পথে। ধনবান পরিবারে জন্মেও তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন কমিউনিস্ট।
পিতা আবুল হাশিম ভারতীয় উপমহাদেশের একজন মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ ছিলেন। কিন্তু বদরুদ্দীন উমর-এর উর্বর মস্তিষ্কে কমিউনিস্ট আন্দোলনের চাষ চলেছে নিরন্তর। সাধারণ মানুষের মুক্তির পক্ষে লড়েছেন কাজেকর্মে, কথনে-বলনে।
আমাদের সামনে এমন অনেকেই আছেন, বার্ধক্যের জন্য যাদের শরীর ও মনের শিরদাঁড়া বলতে গেলে ভেঙে পড়ে, কিন্তু নব্বই অতিক্রান্তেও বদরুদ্দীন উমর ইতিহাসের সামনে সততা-প্রত্যয়-নিষ্ঠা আর মনীষা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন দৃঢ়ভাবে। তিনি ছিলেন শুধু জয়ের নয়, পরাজয়ের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অনুষঙ্গের অনুসন্ধানী একজন সাধকও। বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ যদি হয় প্রথমত, তাই তাহলে বদরুদ্দীন উমর এই কাজটি করে গেছেন সব ভীতি উপেক্ষা করে। এমনজনরা তো যেকোনো দেশে কিংবা সমাজে যুগে যুগে জন্মান না।
ভাষা আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়গুলোতে প্রাণক্ষয়ের মর্মন্তুদ ইতিহাসের প্রেক্ষাপট সচেতন মানুষের অজানা নয়। এই পর্বগুলোতে স্বাধিকারের চেতনা প্রজ্বলনে যারা ঘটিয়েছেন পুনর্জন্ম বলা যায় রেনেসাঁ, এর মধ্যে বদরুদ্দীন উমর স্বতন্ত্র। তাঁর সৃজনী কর্ম অধ্যায় যেন এক অতিপ্রবল স্রোতস্বীনি নদী। সাম্প্রদায়িকতা, সংস্কৃতির সংকট, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (তিন খ-ে), চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, বাঙলাদেশের গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র, বাঙলাদেশের আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাঙলাদেশে দুর্নীতি-সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য, সাম্রাজ্যবাদের বাঙলাদেশের বুর্জোয়া রাজনীতির দুইরূপ ইত্যাদি তাঁর অমূল্য গ্রন্থ।
বদরুদ্দীন উমরকে বাংলাদেশের বাম রাজনীতির অন্যতম দীক্ষাগুরু বলেন অনেকেই। এর চিত্র পাওয়া যায় তার ‘বাঙলাদেশে বুর্জোয়া রাজনীতির দুইরূপ’ ও ‘বাঙলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি’সহ আরও অনেক গ্রন্থে। একবার এক সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করা হয়Ñ এখন বাংলাদেশের বাম রাজনীতির অবস্থা? তখন এর উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আজকের বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির দুরবস্থা রাতারাতি হয়নি। এর ঐতিহাসিক কারণ আছে।
আমাকে শহীদুল্লা কায়সার বলেছিলেন, ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পরে এখানে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যসংখ্যা ছিল ১২ হাজার। তারপর যখন রণদীভের থিসিসের পরে সন্ত্রাস, নির্যাতন ইত্যাদি হলো, কমিউনিস্টদের অনেকে দেশত্যাগ করে চলে গেলেন। এসবের ফলে ১৯৫০-এর পরে এখানে কমিউনিস্টদের সংখ্যা ১২ হাজার থেকে কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ২০০-তে। তার মধ্যেও যারা নেতৃস্থানীয় লোক ছিলেন, তাঁরা এখান থেকে চলে গেলেন। ফলে বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্যরে অভাবও এখানে দেখা দিল। আমি ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় এসে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিই, আমি তো আমার পার্টির নেতৃত্বে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে খুব সামর্থ্যবান কোনো নেতা পাইনি।’ এ রকম বহু সত্য তিনি অকপটে উচ্চারণ করেছেন এবং এ কারণে তিনি বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য অনুসরণীয় হয়ে থাকবেন।
আরও সত্য যেÑ তিনি সততা, নিষ্ঠা, আপোষহীনতা, দৃঢ়তাÑ এসব বিষয়ে বরাবরই ছিলেন অনমনীয়। জীবনযাপনে চেয়েছেন মানুষের মুক্তি। ফলে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ ও সৃজন ভাবনায় অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত ছিল মা মাটি মানুষ। সরাসরি অনেক কাজ করেছেন কৃষক-শ্রমিকদের সঙ্গেও। দেশপ্রেমে ও মূল্যবোধের কারণে বদরুদ্দীন উমর সত্য নির্ভয়ে এবং পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করে গেছেন, যা এই স্তুতি ও প্রশংসার যুগে দুর্লভ।
২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর একটি দৈনিকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বেঁচে থাকা মানুষকে অনুপ্রাণিত করলে বাস্তবে তো দেখতাম। আমি বলব, আমি একধরনের উপেক্ষিত। আমি যে এত কাজ করেছি, আমাকে নিয়ে কোনো জায়গায় কোনো লেখা পাবেন না। এখানে এত লোকের ওপর লেখা হয়, কিন্তু আমার লেখা নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। এমনকি আমার ভাষা আন্দোলনের বইয়ের ওপরও কোনো আলোচনা নেই। কলকাতায় আমার বই ও লেখার ওপরে অনেক আলোচনা হয়েছে। অনেক কৃতবিদ্য মানুষ আমার ওপরে লিখেছেন। সেটা বাংলাদেশে চিন্তাও করা যায় না।
কাজী আবদুল ওদুদ, মৈত্রেয়ী দেবী, নারায়ণ চৌধুরী, অন্নদাশঙ্কর রায়, বিষ্ণু দে, সমর সেন, বিনয় ঘোষ, অশোক মিত্রÑ এঁরা আমার কাজ নিয়ে লিখেছেন, আলোচনা করেছেন। এঁরা বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে উঁচু স্তরের মানুষ। দল-নির্বিশেষে তাঁরা আমার ওপরে লিখেছেন। কিন্তু এখানে দল-নির্বিশেষ উপেক্ষা করা হয়েছে।’ তাঁর এই বক্তব্য আমাদের সামনে প্রশ্ন হয়ে রইল।
জাতীয় পর্যায়ে ‘গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য’ বদরুদ্দীন উমরকে সরকার স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছিল। কিন্তু বদরুদ্দীন উমর সেই পুরস্কার নেননি। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, এর আগেও বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে তাঁকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হলেও, তিনি কোনোটিই গ্রহণ করেননি। যে জামানায় পাওয়া ও নেওয়ার জন্য অনেকেই নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছেন, সেখানে বদরুদ্দীন উমর পাওয়া ও নেওয়ার ব্যাপারে ছিলেন একেবারে নির্মোহ। ক্ষয়ে চলা সমাজে এ-ও তো এক অনন্য নজির। বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি মনীষাদীপ্ত এই তেজস্বীকে।
দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি