ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর, ২০২৫

পাহাড়ি জনপদকে নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা করতে হবে

রেজাউল করিম খোকন
প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২৫, ১২:১৭ এএম

বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার অবস্থান। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। তিনটি পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রধান তিনটি নৃগোষ্ঠী হলেও সেখানে তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই, পাংখো, বম, মুরং (ম্রো), খুমি, খিয়াং, চাক ইত্যাদি আরও অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বসবাস করে। এই অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীগুলো তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারার জন্য পরিচিত এবং এটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। বিস্তীর্ণ পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী জুম চাষ করে, নানা ধরনের ফসল ফলায়। এর মধ্যে শাক-সবজি, ফলমূল, মাছধরা, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু পালন ইত্যাদি কাজগুলোই তাদের জীবিকার উৎস।

পাহাড়ি জনপদে দীর্ঘদিন ধরে সমতল ভূমি থেকে যাওয়া বাঙালিরা গড়ে তুলেছে বসতি। তারা বাড়িঘর তৈরি করে পাহাড়ের মানুষদের পাশাপাশি বসবাস করছে। সেখানে তারা বিভিন্ন ধরনের কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন, চাষাবাদ, ফল বাগান প্রতিষ্ঠা, রাবার বাগান গড়ে তুলেছে। এ ছাড়াও অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় পাহাড়ি বাঙালিদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। পাহাড়ি বাঙালি সবাই মিলে সম্প্রীতির নতুন বন্ধন গড়ে তুলেছে তারা সেখানে। সরকারের পক্ষ থেকে পাহাড়ি জনপদের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সবকিছু করা হয়েছে। গড়ে উঠেছে নতুন নতুন পর্যটনকেন্দ্র। যার উদ্যোক্তা পাহাড়ি বাঙালি উভয়েই রয়েছে। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে পাহাড়ের নানা সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো উদ্যোগ ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে সেখানকার অর্থনীতিতে।

আজ কদিন থেকে হঠাৎ করে পাহাড় হয়ে উঠেছে অশান্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুই জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি অশান্ত হয়ে উঠেছে দুষ্কৃতকারী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের  সন্ত্রাসী কর্মকা-ে। এ সহিংসতা নিয়ে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য একটি চরম হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এখন পাহাড়ি জনপদের  পরিবেশ থমথমে। এটা আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ব্যাপার সন্দেহ নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় সম্প্রীতির বন্ধন যেন নষ্ট না হয়, সেজন্য সবাইকে শান্ত থাকা উচিত বলে মনে করছি। সম্প্রতি  খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী অংম্রাচিং মারমা অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

এ ঘটনায় সেনাবাহিনী কর্তৃক সন্দেহভাজন শয়ন শীলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। অভিযুক্ত আটক ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, সন্দেহভাজনকে আইনের আওতায় আনা হলেও, ধর্ষণের ঘটনায় শুরু থেকেই খাগড়াছড়ির বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদী ইউপিডিএফ নৈরাজ্য সৃষ্টির কার্যক্রম হাতে নিয়ে পরিস্থিতি অশান্ত করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। ইউপিডিএফ সমর্থিত উপজাতি ছাত্র-জনতার ব্যানারে খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় আধাবেলা হরতালের কর্মসূচি পালিত হয়েছে। হরতাল চলাকালে ইউপিডিএফ সমর্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)  ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা খাগড়াছড়িগামী ৪টি বাসের পথ রোধ করে বাসের গ্লাস ভাঙচুর করে ও রাস্তায় গাছ ফেলে রাস্তা বন্ধ করে বাসগুলো আটকে রাখে।

এ ছাড়া তারা মোটরসাইকেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। পাশাপাশি খাগড়াছড়ি সদর, গুইমারা, মানিকছড়ি, রামগড় ও দীঘিনালা উপজেলায় ইউপিডিএফ সমর্থিত উপজাতি নেতাকর্মী গাছের গুঁড়ি ও টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।  ইউপিডিএফ সমর্থিত জুম্ম ছাত্র-জনতার উদ্যোগে ধর্ষণবিরোধী মহাসমাবেশ আয়োজন করা হলে সমাবেশের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেনাবাহিনীর একটি গাড়ির ওপর উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিনা উসকানিতে আক্রমণ করা হয়। এ সময় সেনাবাহিনীর একটা পিকআপ গাড়ি ভাঙচুর করা হয় ও ৪ জন সেনাসদস্য আহত হয়।

এ ধরনের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক ও নিন্দানীয়।এর মাধ্যমে একটি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। একধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের প্রকাশ এটি। এর মাধ্যমে তারা তাদের স্পর্ধা দেখিয়েছে। সম্পূর্ণ ঘটনাকালীন সময়ে প্রথম থেকেই সরকার, সেনাবাহিনী ও পুলিশ অত্যন্ত ধৈর্যের পরিচয় দেয়। ঘটনার অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও, ইউপিডিএফ পরিস্থিতি অন্যদিকে নেওয়ার চেষ্টা করেছে । সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কোনো প্রতিবাদ বা কর্মসূচিতে বাধা প্রদান করেনি। কিন্তু, বারবার বিভিন্ন অজুহাতে সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার প্রয়াস দেখা গেছে। এ ছাড়াও, কোনো কারণ ছাড়াই তুচ্ছ অজুহাতে সেনাবাহিনীর গাড়ির ওপর আক্রমণ ও সেনাসদস্যদের আহত করা হয়েছে। চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে সেনাবাহিনী কোনো বল প্রয়োগ না করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। যা তাদের ধৈর্যের প্রকাশ হলেও মোটেও দুর্বলতা নয়। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। ইউপিডিএফের দায়িত্বশীল বিভিন্ন নেতা টেলিফোনের মাধ্যমে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার নির্দেশনা প্রদান করছে।

ইউপিডিএফের সমর্থনে খাগড়াছড়ি জেলায় সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ পালনকালে  সাজেকে হাজার খানেক পর্যটক আটকা পড়েন, তাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় নারীও শিশুদের কষ্টের সীমা অতিক্রম করেছে তখন। পরবর্তীতে  সেনাবাহিনী তাদের সহায়তা দিয়ে গন্তব্যে নিয়ে যায়। হরতাল চলাকালে জেলার খাগড়াছড়ি সদর, গুইমারা, মানিকছড়ি, রামগড় ও দীঘিনালা উপজেলায় ইউপিডিএফ সমর্থিত উপজাতি নেতাকর্মী গাছের গুঁড়ি ফেলে ও টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এর ফলে জনজীবনে অশান্তি নেমে আসে। এ ছাড়াও বিভিন্ন স্কুল ও হাসপাতালের রোগীদের জীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ। একই ধরনের ঘটনা রাঙামাটিতেও ঘটেছে। এমন ঘটনা এবারই প্রথম নয়। আজকাল প্রায়ই নানা অজুহাতে সেখানে তেমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। যার শিকার হচ্ছে সেখানে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকেরা।

একবার যারা পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন, তারা আবার সেখানে বেড়াতে যাওয়ার কথা মাথায় আনতে পারছেন না। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী সংগঠন ইউপিডিএফের প্ররোচনায় তাদের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন বিশেষ করে পিসিপি কর্তৃক সম্পূর্ণ উসকানিমূলকভাবে দাঙ্গা লাগানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। এবারের এই ঘটনা ছাড়াও ইতোপূর্বে একই ধরনের ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা দেখা গেছে। সম্পূর্ণ বিষয়টিকে ইউপিডিএফের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টির একটি অপপ্রয়াস হিসেবে গণ্য করা যায় অনায়াসেই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাসহ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর তৎপরতা প্রতিরোধে সদা তৎপর রয়েছে। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের জনপদের অবকাঠামো উন্নয়নসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন ও উন্নয়ন ঘটিয়েছে।

শত শত কিলোমিটার দীর্ঘ সুন্দর পিচঢালা পথ তৈরি করে দিয়েছে তারা নিজেদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে। পাহাড়ি জনপদে আধুনিকতার ছোঁয়া আনতে তারা চমৎকার স্থাপনা প্রতিষ্ঠিত করেছে। যা দেখে সবাই মুগ্ধ, বিমোহিত হচ্ছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এতসব অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই।

এখন পাহাড়ে অশান্তি অরাজকতা নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে একটি কুচক্রী মহল। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ধরা হচ্ছে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যদের। তাদের কাছ থেকে বিদেশি অত্যাধুনিক অস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধার করেছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য জানা গেছে আটকৃতদের কাছ থেকে। বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহলের মদতে এই ঘৃণ্য তৎপরতা শুরু হয়েছে পাহাড়ি জনপদে। যেখানে পাহাড়িদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে সমতল এলাকা থেকে গিয়ে বসবাসকারী বাঙালিরা।

কিন্তু এখন তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে, শত্রুতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে সেখানে অশান্তি, অস্বস্তি, পারস্পরিক বিরোধ সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। আমরা চাই, এই নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা অরাজকতা সৃষ্টির পেছনে যারা নেপথ্যে কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা হোক, তাদের মুখোশ উন্মোচন করা হোক। দেশি-বিদেশি সকল চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে গাফিলতি কিংবা অবহেলা কাম্য নয় কারো। দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের দেশের বিস্তীর্ণ পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে ষড়যন্ত্র অনেক আগে থেকেই চলছে। এটা কোনোভাবেই জিইয়ে রাখার সুযোগ দেওয়া যায় না।

সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে আরও সমৃদ্ধ অবস্থানের দিকে। এখানে কোনো ষড়যন্ত্রকারী কুচক্রী মহলকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ দেশ সবার। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। আবহমানকালের সংস্কৃতিও তাই বলে। আমরা সেই ঐতিহ্যকে হারাতে চাই না। চাই না ধর্ম ও সম্প্রদায় নিয়ে হোক কলহ। আমাদের চেতনা হোক-মানবতার, মানবিকতার ও সর্বজনীনতার। আমাদের ধরণিতল হোক কলঙ্কশূন্য। বাংলাদেশ নবচেতনায় জাগ্রত হোক। নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা অরাজকতা থেকে রক্ষা করতে হবে, যেকোনো মূল্যে শান্তি সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে হবে পাহাড়ি জনপদে। 

রেজাউল করিম খোকন: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক