ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর, ২০২৫

‘জনতার সহিংসতা থামাতে কঠোর আইন প্রয়োগের প্রয়োজন’

মো. নূর হামজা পিয়াস
প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২৫, ১২:১৯ এএম

বাংলাদেশের বর্তমান সময়ে এক ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, যা সমাজ, রাষ্ট্র এবং মানবতার ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। এটি কোনো সাধারণ অপরাধ নয়, বরং আইনশৃঙ্খলার এক ভয়াবহ ব্যর্থতার প্রতীক। আমাদের সমাজে আজ ‘জনতা’ নামের এক উন্মাদ শক্তির উত্থান ঘটেছে, যারা নিজেদের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে, মানুষকে প্রকাশ্যে নির্যাতন ও হত্যা করছে, এবং মানবিকতার সব সীমা অতিক্রম করছে।

‘মব’ শব্দটি মূলত ইংরেজি ভাষা থেকে ধার করা হলেও এটি এখন আমাদের সামাজিক জীবনের এক বিভীষিকাময় বাস্তবতা। উচ্ছৃঙ্খল জনতার একটি দল, যারা কখনো প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে, কখনো গুজবের প্রভাবে, আবার কখনো রাজনৈতিক ইন্ধনে খুন, চাঁদাবাজি, প্রকাশ্যে মারধর এবং ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়, আজ রাষ্ট্রের জন্য এক মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্বল বিচারব্যবস্থা এবং প্রশাসনের নীরবতা এই শক্তিকে আরও বেপরোয়া করেছে। ন্যায়বিচার না পেয়ে মানুষ নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে, যার ফলাফল হচ্ছে অমানবিক সহিংসতা এবং অসংখ্য নিরীহ মানুষের প্রাণহানি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি সময়েই রাজনৈতিক অস্থিরতা কোনো না কোনোভাবে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু সম্প্রতি এই অস্থিরতা এক ভিন্ন চেহারা ধারণ করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা এবং বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা জনতার উত্থানকে উৎসাহিত করেছে।

২০২৪ সালের জুলাই মাসে ঘটে যাওয়া বিদ্রোহ এই সংকটের গভীরতাকে প্রকাশ করে। জুলাই বিদ্রোহের সুযোগে এক নতুন সন্ত্রাসী শক্তির আবির্ভাব ঘটে, যারা নিজেদের ‘জনতা’ নামে পরিচিত করে। এই জনতা নিজেদের হাতে আইন তুলে নিয়ে নির্বিচারে হত্যা শুরু করে। 

এই পরিস্থিতি এক গভীর সামাজিক অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী আইনকে নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থার অভাব এই ধরনের ঘটনা বাড়াচ্ছে। যখন উন্মত্ত জনতা সহিংসভাবে নিজেদের রায় কার্যকর করে, তখন তা কেবল একজন ব্যক্তির প্রতি অবিচার নয়, বরং পুরো আইনি কাঠামোকেই দুর্বল করে তোলে। এর ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়, যা সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনের পথে এক বিরাট বাধা।

মানবাধিকার সংস্থা আসক (অ্যাসোসিয়েশন ফর সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল সাপোর্ট)-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে জনতার উন্মাদনার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত জনতার হাতে মোট ১৯৯ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। এই বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১০ জনে।

২০২৪ সালের মাসভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে ২১ জন, সেপ্টেম্বরে ২৮ জন, অক্টোবরে ১৯ জন, নভেম্বরে ১৪ জন এবং ডিসেম্বরে ১৪ জন মানুষ জনতার হাতে নিহত হয়। এবং এ বছরে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত, জানুয়ারিতে ১৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১১ জন, মার্চে ২০ জন, এপ্রিলে ১৮ জন, মে মাসে ১৩ জন, জুনে ১১ জন এবং জুলাই মাসে ১৪ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া এর সংখ্যাটা যদি ভৌগোলিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় তাহলে, ঢাকা বিভাগে ৯২ জন, চট্টগ্রামে ৩৫ জন, খুলনায় ১৮ জন, রাজশাহীতে ১৭ জন, বরিশালে ১৭ জন, রংপুরে ৯ জন, ময়মনসিংহে ৬ জন এবং সিলেটে ৫ জন নিহত হয়েছেন। এই তথ্যগুলো কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি রাষ্ট্রের অকার্যকারিতা এবং জনতার উন্মাদনার ভয়াবহতার প্রমাণ।

গত কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় চোর সন্দেহে দুই ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে একজন রিকশাচালক এবং আরেকজন দিনমজুর। এর আগে ঢাকার মোহাম্মদপুরে ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে এক তরুণ নিহত হন। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, গত এক মাসে অন্তত ২০ জনের বেশি মানুষ গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে এবং সন্দেহভাজনদের বিচারের জন্য পুলিশের হাতে তুলে না দিলে এ ধরনের নৃশংসতা বাড়তেই থাকবে।

এই দৃশ্যগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে আরও নতুন গুজব তৈরি হচ্ছে এবং জনতা উত্তেজিত হয়ে নতুন সহিংসতার দিকে ঝুঁকছে। এই পরিস্থিতি একটি মারাত্মক সাইবার-ঝুঁকি তৈরি করছে, যেখানে ভুল তথ্যের দ্রুত বিস্তার সমাজে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। ক্ষতিকর কন্টেন্ট, যা প্রায়শই বিকৃত বা সম্পূর্ণ মিথ্যা হয়, দ্রুত শেয়ার হওয়ায় তা জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস ও বিভাজন তৈরি করছে। এর ফলস্বরূপ, জনরোষ বেড়ে নতুন করে সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ছে, যা সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে বিঘিœত করছে।

বর্তমানে দেশের সাধারণ মানুষ এক ধরনের স্থায়ী নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করছে। যেকোনো সময় কোনো মিথ্যা অভিযোগে বা গুজবের প্রভাবে একজন মানুষ জনতার হাতে প্রাণ হারাতে পারে। যখন কেউ অপরাধের বিরুদ্ধে মুখ খোলে, তখন সে নিজেই শিকার হয়ে যায়। মুখোশধারী অপরাধীদের ভয় এবং রাষ্ট্রের নীরবতা মিলিয়ে একটি ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। মানুষ এখন দুটি ভয়ের মধ্যে বসবাস করছে। একদিকে সত্য প্রকাশ করলে নির্মম হত্যার শিকার হওয়ার ভয়, অন্যদিকে নীরব থাকলেও গোপন কোনো শত্রুর আক্রমণের ভয়। এর ফলে মানুষ নীরব, অসহায় এবং ভীত হয়ে গেছে।

বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছা অপরিহার্য। রাষ্ট্রকে তার মূল ভূমিকার দিকে ফিরে যেতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষ এবং জবাবদিহিমূলক করা ছাড়া কোনো সমাধান সম্ভব নয়। বিচারব্যবস্থাকে দ্রুত এবং কার্যকর করতে হবে। একই সঙ্গে সমাজে আইন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব প্রতিরোধে প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ নিতে হবে। নাগরিকদের শিক্ষা এবং সচেতনতার মাধ্যমে আইনকে সম্মান করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রে জনতার হাতে আইন তুলে নেওয়ার সংস্কৃতি চলতে পারে না। প্রতিটি নাগরিকের জীবন এবং মর্যাদা রক্ষা করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। যদি রাষ্ট্র নীরব থাকে এবং জনতা শাসন করে, তবে মানবতা ধ্বংস হয়ে যাবে। আজ আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসের প্রয়োজন। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অন্যথায় জনতার উন্মাদনার ঘূর্ণিতে ন্যায়বিচার চিরতরে হারিয়ে যাবে, আর মানবতার কণ্ঠস্বর কেবল নিঃশব্দ কান্নায় মিলিয়ে যাবে।

রাষ্ট্রের নীরবতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি একটি গণতান্ত্রিক সমাজের মূল ভিত্তিকেই নড়বড়ে করে দেয়। রাষ্ট্রের উচিত নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। জনতার হাতে বিচার তুলে নেওয়ার প্রবণতা রুখতে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করাও জরুরি। পরিবার, সমাজ, এবং রাষ্ট্রের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই অরাজকতা থামানো অসম্ভব। যদি এই প্রবণতা চলতে থাকে, তবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষের জীবন ও মৌলিক অধিকারও বিপন্ন হবে।

মো. নূর হামজা পিয়াস
শিক্ষার্থী, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ