ঢাকা শুক্রবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৫

সরকারি হাসপাতালে দালাল সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: অক্টোবর ১০, ২০২৫, ০১:১৭ এএম

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে যখন প্রশাসন, রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ প্রতিটি খাতে সংস্কারের হাওয়া বইছে, তখন স্বাস্থ্য খাতে এখনো আগের মতোই দুর্নীতির ঘুণপোকা বসে আছে। শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাম্প্রতিক চিত্র সেই ঘুণের প্রকট প্রতিচ্ছবি। এখানে রোগীর চিকিৎসার চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে ঘুষ, দালালি ও কমিশনের রাজনীতি। বলা চলে, হাসপাতালটি আজ একদল অসাধু কর্মচারীর নিয়ন্ত্রণে পরিণত হয়েছে, যারা নিজেদের পকেট ভরতে জনগণের জীবন নিয়েও ছিনিমিনি খেলছে।

বৃহস্পতিবার রূপালী বাংলাদেশে ‘সোহরাওয়ার্দী মুমূর্ষু: পা ফেলতেও লাগে টাকা!’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই সিন্ডিকেটের আদ্যোপান্ত। প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে দেখা য়ায, রোগী ভর্তি থেকে শুরু করে একটি ট্রলি বা হুইলচেয়ার পাওয়ার জন্যও দিতে হয় টাকা। এমনকি হাসপাতালের গজ, তুলা, পর্দা, সবই বিক্রি হচ্ছে দেদার। সরকারি অর্থে কেনা ওষুধ বাজারে চলে যাচ্ছে, সরকারি যন্ত্রপাতি বিক্রি হচ্ছে গোপনে, আর তাতে ভাগ বসাচ্ছে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এই চক্রের হোতাদের নামও কারো অজানা নয়, জরুরি বিভাগের ইনচার্জ হান্নান মুন্সি, আউটসোর্সিং সুপারভাইজর জাহিদ হোসেন, হিসাবরক্ষক কাজী মুরাদ হোসেন, পরিচালকের পিএ মোহাম্মদ নাঈম হোসেন, ওয়ার্ড সরদার আমিনুল ইসলাম, ক্যাশিয়ার মামুন, ওয়ার্ড মাস্টার সাইদুল ইসলাম লিটন ও জাকির হোসেন উকিল-এরা বছরের পর বছর হাসপাতালটিকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে।

দুর্নীতির এই সিন্ডিকেট শুধু আর্থিক অনিয়মেই সীমাবদ্ধ নয়; তারা হাসপাতালের প্রশাসনিক কাঠামোও নিয়ন্ত্রণ করে। কে কোন ওয়ার্ডে ডিউটি করবে, কে আউটসোর্সিংয়ে চাকরি পাবে, কার সিট হবে, এমনকি কোন রোগীকে কোন বেসরকারি ক্লিনিকে পাঠানো হবে-সবকিছুই তাদের অনুমতি ছাড়া হয় না। আউটসোর্সিংয়ের নিয়োগে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়া হয়েছে, ইমার্জেন্সিতে সিট দিতে আদায় করা হচ্ছে হাজার হাজার টাকা, আর যারা টাকা দিতে অস্বীকার করে, তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বেসরকারি ক্লিনিকে, যেখানে সিন্ডিকেটের কমিশন বয়ে আনে নতুন আয়।

আশার কথা হলো, বর্তমান পরিচালক ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিন কিছুটা উদ্যোগ নিয়েছেন, প্রায় ১৫ জন কর্মচারীকে বরখাস্তও করেছেন। কিন্তু এটি সমস্যা সমাধানের শুরু মাত্র। সিন্ডিকেটের মূল শেকড় এখনো অটুট। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও বিষয়টি জানে এবং মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর নিজেও ছদ্মবেশে গিয়ে এই অনিয়ম দেখেছেন বলে স্বীকার করেছেন। প্রশ্ন হলো, দেখার পরও কেন এখনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি? কেন হাসপাতালের পরিবেশ আজও একই রকম দুর্নীতিগ্রস্ত?

বিষয়টি কেবল একটি হাসপাতালের নয়; এটি সারা দেশের অধিকাংশ সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। দেশের অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা এক ধরনের ‘মাইক্রো প্রশাসন’ চালায়। তারা প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায় থেকে চিকিৎসকদেরও ‘নির্দেশ’ দেয়, রোগীদের সঙ্গে করে অর্থ বাণিজ্য। রোগী ভর্তি বা ছাড়পত্রে টাকা, এমনকি মৃতদেহ হস্তান্তরেও টাকার লেনদেন, সরকারি হাসপাতালে ‘নিয়মিত প্রথা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একটা হাসপাতাল কেবল ইট-পাথর বা যন্ত্রপাতির সমষ্টি নয়; এটি রাষ্ট্রের মানবিক চেহারার প্রতিফলন। সেখানকার প্রতিটি বিছানায় লুকিয়ে থাকে অসংখ্য সাধারণ মানুষের আশা, ভরসা, জীবনের শেষ আশ্রয়। সেই আশ্রয় যদি রূপ নেয় দুর্নীতি, দালালি ও ভয়ংকর বাণিজ্যে, তবে রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিই নড়ে যায়।

এখন প্রয়োজন একটি সামগ্রিক ও সাহসী উদ্যোগের। প্রথমত, সিন্ডিকেটে জড়িত প্রত্যেককে দ্রুত চিহ্নিত করে চাকরিচ্যুত করতে হবে সেই সঙ্গে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সরকারি হাসপাতালগুলোর প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি। বিশেষ করে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ওপর দীর্ঘস্থায়ী নজরদারি ও জবাবদিহি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তৃতীয়ত, আউটসোর্সিং নিয়োগে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নিয়োগপ্রক্রিয়া চালু করতে হবে।

জনগণের করের টাকায় পরিচালিত হাসপাতালগুলো জনগণেরই সম্পদ। কোনো সিন্ডিকেটের ব্যক্তিগত লুটপাটের কেন্দ্র নয়। স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার মানে শুধু নতুন ভবন বা যন্ত্রপাতি কেনা নয়, বরং সৎ প্রশাসন ও মানবিক সেবা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

কেননা, সরকারি হাসপাতাল একটি ভরসার জায়গা, নির্ভরতাহীন দালালের আশ্রয়স্থল নয়। দুর্নীতির সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে সংস্কারের সব প্রতিশ্রুতিই অর্থহীন হয়ে যাবে।