বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত দীর্ঘদিন ধরেই সুশাসনের চ্যালেঞ্জের মুখে। খেলাপি ঋণের স্ফীতি, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য, এবং নিয়মকানুন প্রয়োগে দুর্বলতা, এসব পুরোনো সমস্যাই সময়ের সঙ্গে আরও প্রকট হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মধুমতি ব্যাংককে ঘিরে উঠা ঘটনাপ্রবাহ আবারও মনে করিয়ে দেয়, একটি ব্যাংকের আর্থিক স্থিতি শুধু ব্যালান্সশিট দিয়ে নয়, তার পরিচালনা পর্ষদের নৈতিক অবস্থান ও জবাবদিহির ওপর সমানভাবে নির্ভরশীল।
বৃহস্পতিবার রূপালী বাংলাদেশে ‘ভানুমতির খেল মধুমতিতে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে আসে একটি মধুমতি ব্যংকের সার্বিক চিত্র।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধুমতি ব্যাংকের কয়েকজন পরিচালক, দীর্ঘদিন সভায় অনুপস্থিত, কারো বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতি, অর্থপাচার বা হত্যা মামলার অভিযোগ, আবার কেউ ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত। তবুও নিয়ম লঙ্ঘন সত্ত্বেও তারা পদে বহাল আছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধান অনুযায়ী, পরপর তিনটি সভায় বা তিন মাস অনুপস্থিত থাকলে পরিচালকের পদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে শূন্য হওয়ার কথা। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, মধুমতি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ধারাবাহিকভাবে ছুটি অনুমোদন বা বাড়িয়ে দিয়ে অনুপস্থিত পরিচালকদের পদে বহাল থাকতে সাহায্য করছেন। যা আইন ও নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
চেয়ারম্যান হুমায়ূন কবীরের বিরুদ্ধেও ঋণখেলাপির অভিযোগ উঠেছে, যা ব্যাংক কোম্পানি আইনে পরিচালক পদে থাকার যোগ্যতাকে সরাসরি প্রশ্নবিদ্ধ করে। অপরদিকে, পরিচালনা পর্ষদের আরও সদস্যদের বিরুদ্ধে হত্যা, দুর্নীতি ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অভিযোগ বিভিন্ন সংস্থায় তদন্তাধীন। এসব অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত না হলেও, ব্যাংকের শীর্ষ পরিচালকদের বিরুদ্ধে এতগুলো গুরুতর অভিযোগ থাকা বড় উদ্বেগের কারণ। কেননা ব্যাংকিং খাত মূলত আস্থার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, আর পরিচালনা পর্ষদ সেই আস্থার সবচেয়ে মৌলিক ভিত্তি।
এই যখন ব্যাংকটির আভ্যন্তরীণ অবস্থা তখন সামনে এসছে আরও একটি অস্বস্তিকর বাস্তবতা। আর তা হলো পরিচালনা পর্ষদের বড় অংশের রাজনৈতিক সংযোগ ও পারিবারিক সম্পর্ক। ব্যাংকটিতে এখনো বহাল তবিয়তে আছেন শেখ পরিবারের সদস্যরা। পরিবারকেন্দ্রিক প্রভাব এবং রাজনৈতিক আশ্রয়ে যেকোনো ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া যখন নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন সুশাসনের জায়গা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। ফলে ব্যাংক পরিচালনা আর পেশাদারিত্ব বা নৈতিকতার ওপর নয় বরং সম্পর্ক, ক্ষমতা ও প্রভাবের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংক অতীতে একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছে যে, কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, অভিযোগগুলো প্রকাশ্যে থাকার পরও কেন এখনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার শক্তি কতখানি, এ প্রশ্নই আবারও নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
আমরা মনে করি, ব্যাংকিং খাতে প্রয়োজন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও কঠোর আইন প্রয়োগ। পরিচালনা পর্ষদে কারা আছেন, তাদের যোগ্যতা কী, তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আছে, এসব বিষয়ে প্রকাশ্য তথ্যপ্রবাহ এবং সক্রিয় নিয়ন্ত্রণই সুশাসন ফিরিয়ে আনতে পারে। মধুমতি ব্যাংকের ঘটনাটি শুধু একটি ব্যাংকের সংকট নয়। এটি গোটা ব্যাংকিং খাতের জন্য সতর্কবার্তা। এখনই যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো আইন প্রয়োগে দৃঢ় অবস্থান না নেয়, তাহলে পুরো খাতই আরও গভীর আস্থাহীনতার মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
ব্যাংকিং খাতে গোষ্ঠীকরণ, পারিবারিক প্রভাব আর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের জায়গা নেই। ব্যাংক পরিচালনা একটি জাতীয় দায়িত্ব, এটি কখনোই ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। আর সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায় কোনোভাবেই সাধারণ আমানতকারীদের ওপর বর্তাতে পারে না।
আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, নীতিমালা ভঙ্গকারী যে-ই হোক, রাজনৈতিক বা পারিবারিক পরিচয় যা-ই থাকুক না কেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত, স্বচ্ছ ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তা না হলে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন আসবে না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, একটি দেশের অর্থনীতি কখনো দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর ভর করে টেকসই হতে পারে না।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন