সংগীত আমাদের প্রাণের খোরাক- এই খোরাক বহুমাত্রিকতায় শ্রবণ করে শ্রোতা। শ্রোতাকে মগ্ন করতে সংগীত নিয়ে পাগলামী করে কত তরুণ, তার অন্ত নেই। অন্তহীন এই যাত্রায় নেমেছেন একদল তরুণ। সূর্যের পাঁজরে আলো জমা রেখে, স্বপ্নের মিছিলে অংশ নেওয়া একদল তরুণ কবিতা-গানে সুরের দেহসূত্রে মগ্ন হয়। যেসব তরুণ ফেরি করে সুরের আনন্দ অথবা বেদনার উল্লসিত মায়ায়। সংগীতের মায়ার জালে বেঁধে রাখে শ্রোতার মন। এসব কিছুই সুরের বাহানা, সংগীতের সাধনা। মানুষের স্বপ্ন থাকে, স্বপ্নের উপর ভর করেই বেঁচে থাকে, ছুটে চলে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। এই ছুটে চলা কারো সার্থক হয়, আবার কারো হয় না। অনেকের সামর্থ্য না থাকার কারণে সবকিছু হয়ে যায় গুড়েবালি। সবাই এক চেতনার মানুষ নয়, প্রতিটি মানুষের চিন্তা ভিন্ন। তাই স্বপ্ন দেখেন বহুমাত্রিকতায়, কেউ বড় লোক হওয়ার, আবার কেউ সৃজনশীল কাজে বড় হওয়ার, কেউ সুরের রাজা হওয়ার জন্য ছুটে চলেন গানের সঙ্গে, সুরের স্রোতে। স্বপ্ন দেখার জন্য বয়স লাগে না, বড় হওয়ার স্বপ্ন ছোট থেকেই দেখতে হয়।
একদল তরুণ নাটকের দলে কাজ করতেন। নাটক সমাজের দর্পণ, তরুণদের এমন স্বপ্নের পাশে লুকিয়ে রেখেছিল সুরের দেহ। এ দেহ দিয়ে শ্রোতাদের আনন্দ দেবে, সুর পছন্দ মানুষের হৃদয়ের খোরাক জোগাবে। তাদের এ জোগানোর স্বপ্ন ছোট থেকেই। জন্মের কাতারে দাঁড়িয়ে যায় গানের দল, ভিন্ন ধারার গানের দল, ‘দল অন্যরকম’। যে দলের গানে ভাসে মাটির ঘ্রাণ। আত্মার গভীরের সুরের চর্চা হবে- এমন চিন্তা চেতনা থেকেই ২০২০ সালে এ দলের জন্ম।
সংগীতের মৌলিক ধারার চর্চা করার প্রত্যয় নিয়েই ‘দল অন্যরকম’র প্রতিষ্ঠা করা হয়। মূলত মাটির গান, গ্রামের গান, চেতনার গান ও মুক্তির গান নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে ‘দল অন্যরকম’। এই দল আর দশটি গানের দলের মতো নয়। ঐতিহ্যবাহী নাটকের সংগঠন ‘বগুড়া থিয়েটার’র নাট্যকর্মীরাই এই দলের আলোকবর্তিকা। তারা আত্মার গভীরে প্রবেশ করে নিজেকে অনুসন্ধান করাই হচ্ছে তাদের গানের অভিযাত্রা। আত্মার গভীর স্পর্শ করে শ্রোতার মন জয় করা একজন শিল্পীর প্রধান কাজ। এই অর্জন যারা করতে পারেন তারাই প্রকৃত গানসাধক, প্রকৃত কণ্ঠশিল্পী। এমন সাধনায় গান করছেন। ‘দল অন্যরকম’র শিল্পীরা। সুরেলা ধ্বনি ব্যবহার করে শ্রোতার ভেতরের অনুভূতি স্পর্শ করে এ দল শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু নিভৃতচারী হওয়ার কারণে আড়ালেই রয়ে গেছে ‘দল অন্যরকম’।
ভিউ-বাণিজ্যের এ সময় একটু সামনে আসতে হয়, আলোয় আসতে হয় কিন্তু এ দলের সংগীত তুর্কিরা আলোয় না এসে নিজেরা সুরের আলো ফেরি করেন শ্রোতার মন থেকে গভীর হৃদয়ে। সংগীতের মাধ্যমে আত্ম-উপলব্ধি এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির একটি উপায়কে নির্দেশ করে। এটি সংগীতের মাধ্যমে নিজের ভেতরের গভীর অনুভূতি এবং চেতনাকে উপলব্ধি করে শ্রোতার হৃদয়ে সুরেলা ধ্বনির উল্লাসে উদ্বেলিত করাই শিল্পীর মহান কাজ। যে কোনো ধরনের সংগীত ব্যক্তির মনে গভীর অনুভূতি তৈরি করে এবং আত্ম-উপলব্ধিতে সাহায্য করে। কিন্তু ভিন্ন রকম পরিবেশনা শ্রোতার মনে অন্যভাবে দাগ কাটে। যে দাগে অনুভূত হয় স্নিগ্ধ সকালের আলোর মতো, আকাক্সক্ষার ভেলায় সুর তরঙ্গের যাত্রা। এ যাত্রার মাঝি ‘দল অন্যরকম’।
এটি গানের দল, শুধু গানের দলই বা বলি কেন? এই দলের পরিবেশনায় কখনো যুক্ত হয় কবিতা, গল্প, রম্যকথা এরপর তার সঙ্গে ভাবের সাযুজ্য রেখে শুরু হয় গান, আবার সেই গানের রেশ রেখেই আরেক গানের সঙ্গে একটা সেতু নির্মিত হয়। একটানা চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট চলমান পুরো অনুষ্ঠান মনে হয় একটা জার্নি। ফলে দর্শক নানা ভাব ও রসের বৈচিত্র্য নিয়ে সময়টা পার করে। দল অন্যরকমের রিদমিক পার্টেও রয়েছে বৈচিত্র্যতা। হারমনি, ঢোল, তবলা, কলস, ডারবুকা, খমক, নাকাড়া, মাদল, বাঁশি, বেহালা, কাহন, করতালের মতো বাংলাদেশের নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে একোস্টিক গিটার ও ইলেকট্রিক গিটার মিশিয়ে এক অন্যরকম ফিউশানের চেষ্টা করেন তারা।
দল অন্যরকম এর গানের অংশের মূল দায়িত্ব পালন করেন সোবহানী বাপ্পী আর কবিতা বা কথা অংশে মূল ভূমিকা পালন করেন অলক পাল। দোহার, পার্কেশন ও রিদমিক পার্টে সহায়তা করেন বায়েজিদ নিবিড়, স্বরণ, আমিনুল রকি, রবিউল করিম, গালিব, সানাউর রহমান ও নাঈমুল। এ দলের জন্য প্রত্যেকই অনিবার্য। কারণ তারা প্রত্যেকেই নিজের জায়গা থেকে শ্রোতার মন জয় করার জন্য তাদের নান্দনিক কৌশল এবং নির্ভেজাল প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।
মঞ্চের অভিজ্ঞতা নিয়ে দলের অন্যতম অগ্রজ সদস্য অলক পাল বলেন, ‘দল অন্যরকম এর সদস্যরা প্রত্যেকেই বগুড়া থিয়েটার ও কলেজ থিয়েটারের নাট্যকর্মী ফলে তাদের পরিবেশনায় রয়েছে নাটকীয়তা। কখনো এই দলটি তাৎক্ষণিক ইম্প্রভাইজেশনে দর্শকের সঙ্গে নাটকীয়তাও করে থাকে ফলে দর্শক একসঙ্গে নানা স্বাদের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। বগুড়া থিয়েটারের মঞ্চনাটকে অংশ নেওয়ার পর থেকে নিয়মিত গানে-কবিতার চর্চা করে যাচ্ছে।’
সংগীত জীবনের কথা বলে, চিন্তা করতে শেখায়, জীবনের প্রতিটি বাঁকে সংগীতের সুর বিরাজ করে। গান পছন্দ করেন না, এমন মানুষ পাওয়া দায়। শিল্পীর কিছু দায় থাকে। এই দায় থেকেই এ দলের সৃষ্টি। আর দায়মুক্তির জন্য এ দলে যুক্ত হন সোবহানী বাপ্পী। যিনি ‘দল অন্যরকম’র গানের অংশের মূল দায়িত্ব পালন করেন।
গান নিয়ে সোবহানী বাপ্পীর প্রত্যাশা পাহাড় সমান। তার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমরা যেহেতু থিয়েটার কর্মী আমরা এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালোবাসি। গান আর কবিতায় মঞ্চে একটা ভিন্ন আবহ সৃষ্টি করে দর্শকের কাছে পরিবেশনা নিয়ে যাচ্ছি। সারা পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে আমাদের গানাবৃত্তি এটি আমাদের প্রত্যাশা।’
সৃজনশীল মানুষ বলতেই স্বপ্নবাজ হন, স্বপ্ন দেখেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। এসব স্বপ্নবাজ মানুষ যেতে চান বহুদূর, দূরের আলো ছুঁতে নিজেদের নির্মাণ করেন শৈল্পিক চিন্তায়। ‘দল অন্যরকম’র শুরুর গল্পটাও রোমাঞ্চকর জানালেন অলক পাল। তিনি বলেন, ‘২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙ্গায় বগুড়া থিয়েটার নাটকের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিল। সেখানে আয়োজকবৃন্দ দলটির কাছে নাটকের পূর্বে বাংলাদেশের গান শোনানোর অনুরোধ রাখেন। হঠাৎ এই অনুরোধে আমরা সদস্যরা তাৎক্ষণিকভাবে কবিতা ও গানের সংমিশ্রণে এক চমকপ্রদ পরিবেশনা উপহার দিই। উপস্থিত প্রায় হাজার দর্শক ভালোবাসায় সিক্ত হই আমরা।’
নাম ‘দল অন্যরকম’ কেন হলো এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কিছুটা অন্যরকমভাবে শুরু হয়েছিল বলেই এ দলের নাম ‘দল অন্যরকম’। আমরা অনুষ্ঠান ভেদে গান নির্বাচন করি। যেমন- গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে শুধু বিয়ের গীত বা বিয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গান-কথার পরিবেশনা উপস্থাপন করি। আবার স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে কখনো ফোক বা ফোকের সঙ্গে ব্যান্ডের গানেরও চমৎকার মিশেল ঘটাই। দর্শক-শ্রোতা পাশে থাকলে আরও ভালো করতে পারব বলে আশা করছি।’
এই দলটির স্লোগান বেশ চমৎকার ও নান্দনিক, কবিতা আর বাংলা গানে মন ভাসুক ভাটি কিংবা উজানে। এ স্লোগান নিয়েই পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা যাবে। অন্য একদিন না হয় লিখব। আজ দল অন্যরকম এর মূল ভোকালিস্ট সোবহানী বাপ্পীর প্রত্যাশার কথা জানব। তিনি তার পাহাড় পরিমাণ প্রত্যাশা নিয়ে বলেন, ‘দলটিতে আমরা চেয়েছি অন্যরকম কিছু হোক। প্রতিনিয়ত আমরা ভাঙ্গা-গড়ার মধ্য দিয়ে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করছি। এখন পর্যন্ত যা দর্শক সাড়া পাচ্ছি তা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। আমাদের মৌলিক গান তিনটি রয়েছে আমরা সংখ্যাটিকে বাড়ানোর চেষ্টা করছি। বর্তমান সময়ে যদিও সারা দেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান খুবই কম হচ্ছে তারপরেও দল অন্যরকম প্রতিনিয়ত নানা ধরনের শো পাচ্ছে।’
দলের সদস্য বায়েজিদ নিবিড় বলেন, ‘এক শ্রেণির মানুষ ছাড়া সাধারণ দর্শক কবিতা শুনতে কম পছন্দ করে কিন্তু দল অন্যরকম এর পরিবেশনায় নানা কবির কবিতাও দর্শককে শোনানো সম্ভব হয় ফলে কবিতার দর্শক সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা চাই আমাদের পরিবেশনা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজসহ দেশে ও দেশের বাইরে রুচিশীল দর্শকের মাঝে নিয়ে যেতে।’
সহজ-জটিলতার হিসাবে তার সুরের খেলা হয়। জমা হয় তার অর্জনের নামতা। দর্শক-শ্রোতার দোয়া-ভালোবাসা থাকলে আরও এগিয়ে যাবে এ গানের দল। গান যুদ্ধে জয়ী হয়ে বগুড়া তথা বাংলাদশের মুখ উজ্জ্বল দেশের গান পৌঁছে দিক দেশ থেকে দেশান্তরে, দূরদেশে। ‘দল অন্যরকম’ এমন একটি গানের দল, যারা বুকের পাঁজরে জমা রাখে নান্দনিক সুর। এই সুর বিলি করেন গ্রাম-গঞ্জে, নগরে-মহানগরে, নীরবে নিভৃতে দূরের দেশে।