‘মিরাই’, ‘লোকাহ চ্যাপ্টার-১ চন্দ্রা’ এবং সবশেষ ‘কান্তারা চ্যাপ্টার-১’। যারা দক্ষিণ ভারতের সিনেমা নিয়মিত দেখেন কিংবা খোঁজ রাখেন তারা নিশ্চিই জানেন সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমাগুলো বক্স অফিসে কি রকম তা-ব চালাচ্ছে। দক্ষিণ ভারতের পৌরাণিক কাহিনি, লোকগাথা এবং অতিমানবীয় চরিত্রের গল্প দর্শকদের দারুণভাবে মুগ্ধ করছে। বিশেষ করে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে একটা বড় সংখ্যক দর্শক ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে, যারা কিনা বলিউডের সিনেমা এড়িয়ে দক্ষিণ ভারতের সিনেমায় বুঁদ হয়েছেন। আসলে সময় এবং কনসেপ্ট চমৎকার করে মিশিয়ে বর্তমান সময়ের সিনেমাপ্রেমীদের মন্ত্র মুগ্ধের ন্যায় মোহিত করছে রাজা মৌলি, সুকুমাররা।
ভারতীয় মিথলজি, স্থানীয় পুরাণ, লোকগাথা কিংবা আঞ্চলিক সংস্কৃতি- স্ক্রিনে ফেলে বৈশ্বিকরূপ দিয়ে বিশ্ববাজারে ভারতীয় সিনেমরা সংজ্ঞাই বদলে দিয়েছে। গল্প এবং নির্মাণের মুন্সিয়ানায় বহির্বিশ্বে বলিউডকে পেছনে ফেলে ‘সাউথ ইন্ডিয়ান মুভি’ একটি নতুন যুগ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশেও দক্ষিণী সিনেমার ব্যাপক জনপ্রিয়তা। গত ৪ এপ্রিল নেটফ্লিক্সে আর মাধুবন, নয়নতারা এবং সিদ্ধার্থ অভিনীত তারকা বহুল সিনেমা ‘টেস্ট’ মুক্তি পায়। মুক্তির প্রথম সপ্তাহ পর দেখা যায় ভারতের বাইরে এই সিনেমা সব থেকে বেশিসংখ্যক দর্শক দেখেছে বাংলাদেশ থেকে। মূলত ‘বাহুবলী’র পর বাংলাদেশসহ অন্য মহাদেশগুলোতে দক্ষিণ ভারতের সিনেমা এক অনন্য মাত্রায় পৌঁছে গেছে।
গত ২ অক্টোবর মুক্তি পাওয়া কন্নড় সিনেমা ‘কান্তারা চ্যাপ্টার-১’-এর জলন্ত দৃষ্টান্ত। মুক্তির পর থেকেই আলোড়ন সৃষ্টি করছে। সুপার ক্লাইম্যাক্সের এই সিনেমা পাহাড়ের আদিবাসী এবং নগরের অধিবাসীর মধ্যে আলাদা আলাদা বিশ্বাসের দৃষ্টিকোণের গল্পে নিয়ে নির্মিত। গল্পের উপজীব্য প্রেম, বিশ্বাস এবং বিশ্বাসঘাতকতা- যার সঙ্গে স্থানীয় মিথ বা পুরাণ এবং লোকগাথা মিলে একটি চমৎকার এপিক ড্রামা তৈরি করেছে। ২০২২ সালে মুক্তি পায় এই সিনেমার প্রথম কিস্তি।
কান্তারার মূল চরিত্র এবং পরিচালক একজন। ঋষভ শেঠি যে কিনা দ্বিতীয় পর্বে নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। পর্দায় দেখে তাকে বিশ্বাস করা যাবে না ‘বারমে’ চরিত্রের বাইরে তার অন্য কোনো অস্তিত্ব আছে! ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকে বলছি, ঋষভের অভিনয় মাথা ঘুড়িয়ে দিয়েছে! অভিনয়ের চৌম্বক শক্তি দিয়ে দর্শকদের এভাবে আর্কষিত করা যায় ‘কান্তারা চ্যাপ্টার-১’ না দেখলে বোঝানো বা অনুভব করানো সম্ভব নয়। আর এই আর্কষণটাই দক্ষিণী সিনেমা জিইয়ে রেখেছে।
এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত মাত্র ৪ দিনে বিশ্বব্যাপী ৪১৪ কোটি রুপি আয় করে ‘কেজিএফ চ্যাপ্টার-১’কে পেছনে ফেলেছে ‘কান্তারা চ্যাপ্টার-১’। এ রকম ম্যাসিভ গ্রোথ কন্নড় ভাষার কোনো সিনেমার ক্ষেত্রে এখনো ঘটেনি বলে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও ঋষভ শেঠি এটা করে দেখিয়েছে!
অন্যদিকে, গত ২৮ আগস্টের সিনেমা লোকাহ চ্যাপ্টার ১: চন্দ্রা’ সাফল্যের দৌড়ে পিছেয়ে নেই। সুপারওম্যান গল্পের এই সিনেমা সাধারণ দর্শক থেকে সমালোচকসহ সবারই প্রশংসা পেয়েছে। গত সপ্তাহে ৩০০ কোটি রুপি আয়ের মাইলফলকও স্পর্শ করেছে সিনেমাটি।
কল্যাণী প্রিয়দর্শন অভিনীত ‘লোকাহ চ্যাপ্টার ১: চন্দ্রা’ পরিচালনা করেছেন ডমিনিক অরুণ এবং প্রযোজনা করেছে দুলকার সালমানের ওয়েফেয়ারার ফিল্মস। অতিমানবীয় এক নারীর সঙ্গে বর্তমান সময়ের এক যুবকের গড়ে ওঠা সম্পর্ক যা তাকে আরও বেশি অতিমানবীয় করে তলে। এবং শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক গিয়ে একটি প্রেমের ছায়ামূর্তির রূপ পায়। কল্যাণী প্রিয়দর্শন সুপারওম্যান চরিত্রে দারুণ করেছে। সিনেমাটি শুধু ভারতের দক্ষিণাঞ্চলেই নয়, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও দুর্দান্ত ব্যবসা করছে।
সেপ্টেম্বর মাসের ১২ তারিখ মুক্তি পায় তেলুগু সিনেমা ‘মিরাই’। মাত্র ৩০ কোটি রুপি বাজেটের হিন্দু মিথলোজি গল্পভিত্তিক এই সিনেমা বক্স অফিসে ২০০ কোটি রুপি আয়ের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। কার্তিক ঘাট্টামানেনির পরিচালনায় সিনেমাটিতে অভিনয় করছেন তেজা সাজ্জা, মঞ্চু মনোজ, শ্রিয়া সরণ ও ঋতিকা নায়ক। মুক্তির পর সিনেমাটি সাধারণ দর্শকের পাশাপাশি সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। সমালোচকেরা বলছেন, তেজা সাজ্জার ক্যারিয়ারের এটি সেরা সিনেমা!
দক্ষিণ ভারতের সিনেমার যখন আকাশছোঁয়া অবস্থা তখন বলিউডের খোদ প্রযোজক পরিচালক এবং সুপারস্টার তারকারা নির্দ্বিধায় বলছেন, সার্বিকভাবে বিশ্ববাজারে বলিউডের সিনেমা তার জৌলুশ হারাচ্ছে। বোম্বে ফিল্মের পূর্বের সেই দাপট এখন আর নেই! বলিউডের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে দক্ষিণ ভারতের সিনেমা। তালিম, তেলেগু, কন্নড়, মালায়লাম সিনেমার দাপট এখন দেশে দেশে। ষাট বছরের শাহরুখ, সালমান, আমির কিংবা হৃত্বিক রোশনের স্টার ডামের বিপরীতে আল্লু অর্জুন, প্রভাস, মহেশ বাবু, রাম চরণ, এন টি রামা রাও জুনিয়র, ধানুস, সুরাইয়া পাতারু কিংবা হালের টোভিনো থমাস, দুলকার সালমান, ঋশভ শেঠিরা নিজ নিজ কারিশমা দেখিয়ে বর্তমান সময়ে দর্শকেদের মুগ্ধ করে চলেছে।
বলিউডে ২০২৫ সালে ‘ছাওয়া’, ‘সিকান্দার’, ‘রেইড-২’, ‘ওয়ার-২’, ‘সিতারে জামিন পার’, ‘জাট’ সিনেমাগুলোর বাজেট ছিল আকাশচুম্বি! এর বিপরীতে তুলনামুলক কম বাজেট এবং বক্স অফিস সাফল্যের বিবেচনায় দক্ষিণ ভারতের সিনেমা এগিয়ে। বিশেষ করে, ‘রেখাচিত্রম’, ‘অফিসার অন ডিউটি’, ‘থুডারাম’, ‘ড্রেগন’, ‘টুরিস্ট ফ্যামেলি’র মত কম বাজেটের সিনেমা ব্লকবাস্টার। সেখানে সুপারস্টার রজনীকান্তের ‘কুলি’ কিংবা ‘কুবিরা’, ‘এমপুরান’-এর হিসাব নাই বা কষলাম।