ঢাকা মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর, ২০২৫

২৩ বাঁশমহালের বাঁশ-বেত লুট

মুজিবুর রহমান রঞ্জু, কমলগঞ্জ
প্রকাশিত: অক্টোবর ৭, ২০২৫, ০১:৪৫ এএম

*** মৌলভীবাজারে বন বিভাগ
*** দরপত্র আহ্বান করা হলেও নেওয়ার লোক পায়নি বন বিভাগ
*** কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
*** চুরি করা যায় বলে কেউ ইজারা নিতে চায় না : পরিবেশবিদ

মৌলভীবাজারে বন বিভাগের আওতাধীন চারটি বন রেঞ্জে ২৩টি বাঁশমহাল রয়েছে। এসব মহাল বর্তমানে ইজারাবিহীন অবস্থায় থাকায় নির্বিচারে লুট হচ্ছে কোটি টাকার বাঁশ ও বেত। যদিও একসময় সেসব বাঁশমহাল ইজারা দেওয়া হতো। রাজস্ব আদায় হতো কোটি টাকা। কিন্তু এবার দরপত্র আহ্বান করা হলেও নেওয়ার লোক পায়নি বন বিভাগ। এ সুযোগে নির্বিচারে লুট হচ্ছে বনের বাঁশ ও বেত। বনবিভাগ বলছে, ইজারাদারেরা সরকারি দরপত্রের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মূল্য হাঁকিয়ে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করে রাখেন। এ কারণে বাঁশমহাল ইজারা দেওয়া যাচ্ছে না।

পরিবেশকর্মীরা বলছেন, একসময় মৌলভীবাজারের পাহাড়ি এলাকার বাঁশ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করা হতো। বৈধভাবে বাঁশমহাল ইজারা দেওয়া হতো। এর থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হতো। তবে কয়েক বছর ধরে বাঁশমহাল আস্তে আস্তে ইজারা দেওয়া কমে গেছে। চলতি বছর একটি মহাল কেউ ইজারা নেয়নি। মহালে পর্যাপ্ত বাঁশ না থাকায় এ পরিস্থিতি বলে জানান তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার সবচেয়ে বড় বন রেঞ্জ হচ্ছে কমলগঞ্জের রাজকান্দি। এই রেঞ্জে লাওয়াছড়া, চম্পারায়, বাঘাছড়া, ডালুয়াছড়া, কুরমাছড়া, সোনারাইছড়া, সুনছড়া বাঁশমহাল রয়েছে। জুড়ী রেঞ্জে সুরমাছড়া, রাগনাছড়া, পুটিছড়া, পূর্বগোয়ালী, ধলাইছড়া, সাগরনাল, হলম্পাছড়া বাঁশমহাল রয়েছে। বড়লেখা রেঞ্জে লাটুছঠা, হাতমাছড়া, নিকুড়িছড়া, মাধবছড়া ও কুলাউড়া রেঞ্জের পশ্চিম গোগালী, ছোট কালাইগিরি, বেগুনছড়া, লবণছড়া ও বড় কালাইগিরি বাঁশমহাল- ইজারা না থাকায় এসব মহাল থেকে কোটি টাকার বাঁশ নির্বিচারে কেটে বিক্রি করছে একটি প্রভাবশালী মহল। বনের ভেতর বাঁশমহাল হওয়ায় সাধারণ মানুষের আনাগোনা একেবারেই কম। এ সুযোগে বন বিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাঁশ কেটে বিক্রি করে ছড়ার পানিতে ভাসিয়ে সহজে পরিবহন করা হয়।

সরেজমিন দেখা যায়, রাজকান্দি রেঞ্জের ৭টি বাঁশমহালের বেশির ভাগ কেটে নেওয়া হয়েছে। ছোট থেকে বড়, সব ধরনের বাঁশ কাটার প্রমাণ রয়েছে। বাঁশের পরিত্যক্ত অংশ রেখে মূল্যবান অংশ বিক্রির জন্য নেওয়া হয়েছে।

বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলার চারটি রেঞ্জে ২৩টি বাঁশমহাল রয়েছে। এর মধ্যে রাজকান্দি রেঞ্জে ৭টি, জুড়ী রেঞ্জে ৭টি, বড়লেখা ৪ ও কুলাউড়া রেঞ্জে ৫টি বাঁশমহাল রয়েছে। এসব মহালে ৪০ হাজার ৫৫ একর বনভূমি বাঁশমহালের আওতায় রয়েছে। সিলেট বন বিভাগের আওতায় গত ২০ এপ্রিল ২০২৫-২৬ সালের জন্য বাঁশমহালের দরপত্র আহ্বান করেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সিলেট বন বিভাগের হালনাগাদ তালিকাভুক্ত কোনো মহালদার এই দরপত্রে সাড়া দেননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বলেন, আগে যেভাবে মহাল থেকে বাঁশ চুরি হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে এখনো বাঁশ চুরি হচ্ছে। এত বেশি পরিমাণে বাঁশ চুরি হয়েছে যে, এখন আর কেউ বাঁশমহাল ইজারা নিতে চান না। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বনে বাঁশের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাঁশ ও বেতমহালকে টিকিয়ে রাখতে হলে বনবিভাগকে এখনই শক্ত অবস্থানে যেতে হবে।

বাঁশমহালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সাবেক ইজারাদার বলেন, ‘একটি বাঁশ আমরা ২০ টাকায় বিক্রি করি অথচ দরপত্রের মাধ্যমে দেখা যায় এই বাঁশ আমাদের ক্রয়মূল্য, বিক্রি মূল্যের চেয়ে বেশি। এ জন্য কেউ বাঁশমহাল ইজারা নিতে চান না।’

বাধা ছাড়াই বাঁশ চুরি করে বিক্রি করা যায়, এ জন্য কেউ ইজারা নিতে চান না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন জেলা শাখার সভাপতির সালেহ সোহেল। তিনি বলেন, চুরি করে বাঁশ বিক্রির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সময় থাকতে পদক্ষেপ না নিলে বন, বাঁশ, গাছ, বেতসহ বনের প্রাণী কিছুই পাওয়া যাবে না।

মৌলভীবাজার বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক নাজমুল আলম বলেন, বিভিন্ন জটিলতার কারণে বাঁশমহালগুলো ইজারা দেওয়া যাচ্ছে না। বাঁশমহালে কী পরিমাণ বাঁশ আছে, তা পরিমাপ করছে ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বিভাগ। এই রিপোর্ট পাওয়ার পর যেসব মহাল ইজারা দেওয়া যাবে, সেগুলো ইজারা দেওয়া হবে।