দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মিঠাপানির মাছের প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী আবারও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। নদীর দুই তীরে দেদার চলছে শীতকালীন সবজির চাষাবাদ, আর সেই চাষে ব্যবহার করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক সার ও বিষাক্ত কীটনাশক। পাশাপাশি রাতের আঁধারে চলছে বালু উত্তোলন, যা হালদার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গতকাল শুক্রবার সরেজমিন দেখা যায়, নদীপাড়ের চরে মুলা, বেগুন, শিম, টমেটোসহ নানা শীতকালীন সবজি চাষ হচ্ছে। এসব জমিতে ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন রাসায়নিক সার ও ডিডিটি, ফুরাডানসহ নিষিদ্ধ কীটনাশক। বৃষ্টির পানির সঙ্গে এসব সার-কীটনাশক ধুয়ে মিশে যাচ্ছে হালদার পানিতে। ফলে নদীর পানির অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাচ্ছে, মা মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী মারা পড়ছে। এমনকি হুমকির মুখে পড়েছে নদী ও নদীর প্রাণবৈচিত্র্য।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বৃষ্টির পানিতে বিষ ও রাসায়নিক নদীতে মিশে হালদার পানিকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। পাশাপাশি রাতে কিছু চক্র গোপনে বালু উত্তোলন করছে।
একটি কীটনাশক কোম্পানির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে শুধু মাটি নয়, পানি ও বাতাসও দূষিত হচ্ছে। এসব রাসায়নিক ও বিষ মানুষের ক্যানসার, স্নায়ু ক্ষতি, এমনকি বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
নাজিরহাট হেলথ কমপ্লেক্সের সাবেক পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সৌনেম বড়ুয়া বলেন, ‘কীটনাশক ব্যবহারে সঠিক পদ্ধতি না মানলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে। বায়োকন্ট্রোল পদ্ধতি ব্যবহারে পরিবেশ ও মানুষ সুরক্ষিত থাকতে পারে।’
স্থানীয় কৃষক ইউনুস ও শরীফ বলেন, ‘বেশি ফলন ও পোকা দমনে কীটনাশক ব্যবহার করি। তবে এখন বুঝতে পারছি, এতে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। সরকারি সহায়তা পেলে আমরা অর্গানিক চাষে আগ্রহী হবো।’
অন্যদিকে নাজিরহাট সুয়াবিল ও কাজিরহাট এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, একদিকে কৃষক যেমন অতিরিক্ত সার-কীটনাশক ব্যবহার করছে অন্যদিকে রাতের আঁধারে নদীতে বালু উত্তোলনের মহোৎসব চালাচ্ছে। প্রশাসনের অভিযান শেষ হলেই তারা আগের মতো কাজ শুরু করে।
মানবাধিকার নেতা অ্যাডভোকেট ইসমাঈল গণি বলেন, ‘হালদা শুধু একটি নদী নয়, এটি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক মা মাছের ভান্ডার। এখানে কীটনাশক ব্যবহার নদীর প্রাণঘাতী ক্ষতি করছে। প্রশাসনকে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা গবেষক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘হালদায় বালি উত্তোলন সম্পূর্ণ অবৈধ। এতে নদীর তলদেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, মাছের ডিম ছাড়ার স্থান ধ্বংস হচ্ছে। এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে হালদার প্রজননব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘হালদাপাড়ের কৃষকদের অর্গানিক সার ও কীটনাশকবিহীন চাষে উৎসাহিত করতে হবে। না হলে বিষাক্ত পদার্থ নদীতে মিশে মা মাছের মৃত্যু ঘটবে।’
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘হালদা থেকে বালি উত্তোলন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সম্প্রতি দুটি স্পটে অভিযান চালিয়ে বালু উত্তোলনের সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। তবে সুয়াবিল এলাকায় রাতের বেলায় চোরাকারবারিদের ধরতে স্থানীয় সহযোগিতার ঘাটতি রয়েছে।’
ফটিকছড়ি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘কৃষকদের একবারে চাষ থেকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। তবে ধীরে ধীরে তাদের অর্গানিক চাষে অভ্যস্ত করতে হবে। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষতি সম্পর্কে সচেতনতা জরুরি।’