ঢাকা রবিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৫

ভাঙনে তছনছ ৫০ পরিবার

মাসুদ রানা, কুড়িগ্রাম
প্রকাশিত: অক্টোবর ১২, ২০২৫, ০৩:০৩ এএম

হঠাৎ করে কুড়িগ্রামের দুধকুমার নদে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এক রাতেই সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নে নদের তীরবর্তী বানিয়াপাড়া ও মুন্সিপাড়া গ্রামে ভাঙনে তছনছ হয়ে গেছে অন্তত ৫০ পরিবার। এখনো ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে দুই শতাধিক বসতভিটাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। গত সপ্তাহ থেকে উজানের ঢল ও টানা বৃষ্টিতে কুড়িগ্রামের নদ-নদীর পানি বেড়ে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে।

জানা যায়, গত ৫ অক্টোবর দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ শুরু হওয়া ভাঙনে ডান তীরের মাটি নদের পানিতে আছড়ে পড়ার শব্দে ঘুম ভাঙে গ্রামবাসীর। ততক্ষণে সব কিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রান্নাঘর, টিউবওয়েল, বাড়ির সীমানাপ্রাচীর আবার কারো বা ভিটার অংশ নদের গর্ভে বিলীন হতে শুরু করে। জীবন বাজি রেখে রাতের অন্ধকারেই নারী-পুরুষ মিলে বসতঘর ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরানোর কাজ শুরু করে। দিনের আলো ফুটতেই ভাঙনের তীব্রতার সঙ্গে দুর্গতদের কর্মযজ্ঞ বাড়ে। গাছ কেটে নেওয়া, ঘর ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে নিতে এগিয়ে আসেন গ্রামবাসী ও আত্মীয়-স্বজন।

গতকাল দুপুরে সরেজমিনে ভাঙনকবলিত গ্রাম দুটিতে দেখা যায়, এখনো বাড়ি-ঘর ও আসবাবপত্র সরাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন ভাঙনকবলিতরা। কেউ ঘর সরাতে ব্যস্ত আবার কেউ বা গাছ কেটে সরিয়ে নিচ্ছেন। নারী-পুরুষ কিংবা শিশু কারোরই যেন ফুরসত নেই। দুধুকুমারের ক্ষুরধার স্রোতের তোড়ে নদীগর্ভে যাচ্ছে বসতভিটা। পরম যতেœ গড়া বসতির এভাবে বিলীন হওয়ার দৃশ্য হাহাকার নিয়ে দেখছেন বাসিন্দারা।

দুই ছেলে ও চার মেয়ে নিয়ে বানিয়াপাড়ার বসবাস করেন বিধবা আফিয়া বেওয়া। দুধকুমারের আগ্রাসী ভাঙনে একটি ঘরের বেড়া, চালসহ ধাপড়ি চলে গেছে নদীগর্ভে। আরেকটি ঘরের বেড়া ও চাল সরিয়ে রেখেছেন অন্যের জমিতে। ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে চারদিকে। অবশিষ্ট একটি ঘরে গাদাগাদি করে ভাঙন আতঙ্কে রাত্রি যাপন করছেন তারা।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে আফিয়া বেওয়া বলেন, ‘বাপো আমার বাড়ি, ঘর, দুয়োর ভাংগি সোগ চুরমার করি ফেলাইছে নদী। একটি ঘর নদীত চলি গেইছে। খাম, খড়ি কিচ্ছু পাই নাই। সোগ কিছু এলোমেলো করি রাখছি। আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। কটাই যে যামো তার কোনো কূল-কিনারা নাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘দুইটে যে খাম থোমো তারও বুদ্দি নাই। মানুষও পাওয়া যায় না। যার যার ধরি তাই তাই কান্দাকাটি। কারটা কাঁই ধরে? কোদি যে গেইছে কোন জিনিস তার কোনো অস্তি চাম নাই। মাইনষের গাছগাছালি, বাড়ি, ঘর, দুয়োর সোগ কিছু গেইছে।’

আফিয়া বেওয়ার মতো একই পরিস্থিতি ওই গ্রামের আরেক নারী আমেনা বেগমেরও। আমেনা বেগম বলেন, ‘একটা ঘর ভাংগি গেইছে নদীর মদ্দে। আর একটা ঘর নিয়ে য্যায়া ওত্তি থুইছি। এলা কটাই যে যামো তার কোন নির্দিষ্ট নাই। এলা কটাই যে আল্লাহ নিয়ে যাওয়াইবে! কটাই য্যায়া যে পাশর বান্দি!’

দুধকুমারের ক্রমাগত ভাঙনে সমস্ত আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে নিঃস্ব পার্শ্ববর্তী মুন্সিপাড়া গ্রামের জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘নদী ভাঙতে ভাঙতে দাদার রেখে যাওয়া ৬ থেকে সাড়ে ৬ বিঘা আবাদি জমি নদীতে চলে গেছে। এখন আমি নিঃস্ব।’

দুদিন আগেও মুন্সিপাড়া গ্রামে বসতি ছিল দিনমজুর রফিকুল ইসলামের। এ পাড়ায় তার ছিল আধাপাকা বাড়ি। দুটি পরিবার থাকত একটি ভিটায়। কিন্তু দুধকুমারের ভাঙনের কবলে পড়ে তার আধাপাকা বিল্ডিংটিও বিলীন হয়েছে। রফিকুল বলেন, ‘দুধকুমারের ভাঙনে আমার আধাপাকা বিল্ডিং-বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এখন আমি নিঃস্ব। কোথায় যাবো জানি না!’

যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর বলেন, ‘এখানে স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদসহ যাত্রাপুর হাট রয়েছে৷ অসংখ্য মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। সরকার রাজস্ব পায় এ হাট থেকে। ভাঙন প্রতিরোধে দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে যাত্রাপুর হাট ভাঙনের হুমকিতে পড়তে পারে।

এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের বানিয়া পাড়া এলাকায় দুধকুমার নদের ভাঙন রোধের জন্য ইতিমধ্যে ১২ হাজার জিওব্যাগ দেওয়া হয়েছে। আরও কিছু দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বরাদ্দ পেলে আরও দেওয়া হবে।