‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’ রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের এই কবিতার মতো বাংলার মোহময় প্রকৃতি যখন পৃথিবীর অপার্থিব সৌন্দর্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন পুরো পৃথিবী যেন উন্মুখ হয়ে থাকে বাংলার রূপ খুঁজতে। উত্তরের জেলা পঞ্চগড় ঠিক যেন তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। কেননা করতোয়া নদীর পাশে অবস্থিত এ অঞ্চলেই দেখা মেলে ভারতের সিকিম রাজ্যের সঙ্গে নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে অবস্থিত হিমালয় পর্বতের অন্যতম বিস্ময় কাঞ্চনজঙ্ঘার। প্রায় ৮,০০০ মিটার (২৬,০০০ ফুট) এর অধিক উঁচু এই পর্বতশৃঙ্গটিকে পাঁচটি পর্বতচূড়ার কারণে ‘তুষারের পাঁচটি ঐশ্বর্য’ও বলা হয়ে থাকে।
১৮৪২ সালের আগে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বলে ধারণা করা হতো। কিন্তু ১৮৪৯ সালে ভারতের বৃহৎ ত্রিকোণমিতিক জরিপে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেল যে ‘পিক এক্স-ভি’ নামে পরিচিত মাউন্ট এভারেস্টই হচ্ছে পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ। আরও কিছু পুনঃনিরীক্ষণের পর ১৮৫৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় যে কাঞ্চনজঙ্ঘা পৃথিবীর দ্বিতীয় এবং বর্তমানে তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ বলেই অধিক পরিচিত।
সাধারণত অক্টোবর থেকে পঞ্চগড়ে দেখা মেলে এই পর্বতশৃঙ্গের। কিন্তু এ বছর সেপ্টেম্বর থেকেই পঞ্চগড়ের জনপদ ভ্রমণপিপাসুদের এক অদৃশ্য টানে টেনে নিচ্ছে, সমতল ভূমির ওপারে আচমকা দিগন্ত ছুঁয়ে উঠে দাঁড়ানো কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে। কখনো রুপালি, কখনো সোনালি, আবার কখনো সন্ধ্যার গোধূলিতে নীলাভ বর্ণে মোহময় হয়ে উঠছে এ পর্বতশ্রেণি। স্থানীয়দের কাছে এটি দৈনন্দিন দৃশ্য হলেও ভ্রমণকারীর জন্য প্রতিটি ভোর নতুন বিস্ময়। সূর্যের প্রথম আলোকরশ্মি যখন তুষারাবৃত চূড়াগুলোকে আলোকিত করে তোলে, তখন মনে হয়, প্রকৃতি যেন স্বর্ণকার হয়ে পাহাড়ের বুকজুড়ে কাঁচা সোনা ছড়িয়ে দিয়েছে। এই দৃশ্য স্থায়ী নয়; মাত্র ১৫-২০ মিনিটের জন্য এ অপার্থিব জাদু চোখে ভাসে, তারপর মিলিয়ে যায় দিনের আলোর ভিড়ে।
তেঁতুলিয়ার মহানন্দা নদী
ধরে হাঁটতে থাকলে স্পষ্টতই বোঝা যায় প্রকৃতির ভেতর কোনো বিভাজন নেই। ওপারে ভারতের দার্জিলিং, এপারে বাংলাদেশের গ্রাম; কিন্তু আকাশে ভেসে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা একই সঙ্গে দু’দেশেরই, একই সঙ্গে দু’চোখের। নদীর পাড়ে সকালের হিমেল হাওয়ায় কৃষক মাঠে যাচ্ছেন, কেউ গরু নিয়ে লাঙল ধরছেন, কেউ আবার নামাজ শেষে নেমে এসেছেন খেতে। এ সাধারণ জীবনের দৃশ্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অসাধারণ প্রকৃতি, যেন বাংলার গ্রামীণ চিত্রপটে হিমালয়ের তুলির আঁচড়।
তবে তেঁতুলিয়া শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘাই নয়, এখানে ভ্রমণ মানে চা-বাগানের সবুজ কারুকার্য উপভোগ করা। সীমান্তঘেঁষা এই অঞ্চলের প্রতিটি চা-বাগান যেন প্রকৃতির সাজঘর। তাই তো এখানকার সকালে শিশিরভেজা পাতার সারি, দুপুরে রোদ ঝলমলে সবুজ সমারোহ আর সন্ধ্যায় নিস্তব্ধতায় প্রকৃতিপ্রেমীরা মুগ্ধ না হয়ে পারেন না। এ ছাড়া মহানন্দা নদীর তীরে বসে সূর্যাস্ত দেখা, সীমান্তপাড়ের জনপদে মানুষের সরল জীবন দেখার অভিজ্ঞতা ভ্রমণকারীর জন্য বাড়তি প্রাপ্তি।
যেখান থেকে দেখবেন
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা, তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো, তেঁতুলিয়া বাইপাস, ভজনপুর করতোয়া সেতুসহ নানা ফাঁকা জায়গা থেকে ভোরে পরিষ্কার আকাশে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোরম দৃশ্য। বিশেষ করে ভিতরগর এলাকা থেকে সবচেয়ে স্পষ্ট দেখা মেলে বরফে মোড়া এই মহাশৃঙ্গ।
কখন যাবেন
এ বছর সেপ্টেম্বর থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মিলছে। তাই সুবিধামতো যেকোনো সময় যেতে পারেন। তবে প্রতিবছর অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়টা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য সেরা। এ সময় আকাশে মেঘ থাকে না, আবার কুয়াশাও পড়া শুরু হয় না। তাই পাহাড়ের ধবল চূড়া ভেসে ওঠে স্পষ্টভাবে।
ঢাকা থেকে যাওয়ার উপায়
বাস : ঢাকা থেকে সরাসরি পঞ্চগড় বা তেঁতুলিয়ার উদ্দেশে এসি/নন-এসি বাস ছাড়ে। ভাড়া জনপ্রতি প্রায় ১,১০০-১,৯০০ টাকা। হানিফ, নাবিল, বাবুলসহ বিভিন্ন পরিবহনের বাস এই রুটে চলে।
ট্রেন : ঢাকার কমলাপুর থেকে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, একতা বা দ্রুতযান এক্সপ্রেসে সরাসরি পঞ্চগড় যাওয়া যায়। যাত্রাসময় ৮–১০ ঘণ্টা। বর্তমান ভাড়া: শোভন চেয়ার প্রায় ৬৯৫ টাকা, এসি চেয়ার (স্নিগ্ধা) প্রায় ১,৩৩৪ টাকা, এসি কেবিন/প্রথম বার্থ প্রায় ২,৩৯৮ টাকা। প্রতিদিন এই ট্রেনগুলো চলাচল করে।
পঞ্চগড় থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা
পঞ্চগড় বাস টার্মিনালের পাশের ধাক্কামারা মোড় থেকে সারাদিন তেঁতুলিয়ার বাস চলে। জনপ্রতি ভাড়া প্রায় ৫০-৬০ টাকা। তেঁতুলিয়া থেকে ভজনপুর বা বাংলাবান্ধা যেতে ইজিবাইক/সিএনজি পাওয়া যায়। অথবা চাইলে গাড়ি বা মাইক্রোবাস রিজার্ভ নিতে পারেন। সারা দিনের জন্য গাড়ি ২,০০০-২,৫০০ টাকা, মাইক্রোবাস ২,৫০০-৩,৫০০ টাকা লাগতে পারে। ভাগ্য ভালো হলে এশিয়ান হাইওয়ে ধরে যাত্রাপথেই ধবল শৃঙ্গের ঝলক চোখে পড়ে।
যেখানে থাকবেন
তেঁতুলিয়ায় মহানন্দা নদীর তীরে ডাকবাংলো রয়েছে, যেখানে থাকতে হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অনুমতি নিতে হয়। প্রতি কক্ষের ভাড়া প্রায় ৪০০ টাকা।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে কক্ষভাড়া প্রায় ২০০ টাকা। এ ছাড়া ডিসি বাংলো, সীমান্ত পার, কাজী ব্রাদার্স আবাসিক হোটেলসহ বিভিন্ন থাকার ব্যবস্থা আছে। পঞ্চগড় শহরে হোটেল মৌচাক, সেন্ট্রাল গেস্ট হাউসসহ বেশকিছু মধ্যম মানের হোটেল আছে, ভাড়া ৩০০-৬০০ টাকার মধ্যে। এসি কক্ষ এক হাজার টাকার মধ্যেই পাওয়া যায়।
যেখানে খাবেন
তেঁতুলিয়া ও পঞ্চগড় শহরে রয়েছে অনেক খাবারের হোটেল ও রেস্টুরেন্ট। স্থানীয় চা-বাগানে দার্জিলিং জাতের বিখ্যাত চা চেখে দেখার সুযোগও রয়েছে। সাধারণ ভাত, মাছ, মাংসের হোটেলের পাশাপাশি নাস্তা ও চা-কফির দোকান প্রচুর আছে।