বাংলার ইতিহাসে মুঘল স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যে বড় কাটরা একটি অনন্য উদাহরণ। ঢাকা শহরের চকবাজারের দক্ষিণে, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা এই স্থাপনাটি একসময় ছিল রাজকীয় মহিমায় ভরপুর। আজ সেটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলেও এর ভগ্নাবশেষ এখনো ইতিহাসের গৌরবময় কাহিনি শোনায়।
মুঘল আমলে সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার নির্দেশে ১৬৪৪ সালে দেওয়ান মীর আবুল কাসিম এই ভবনটি নির্মাণ করেন। তিনি ছিলেন শাহ সুজার প্রধান স্থপতি, যিনি ‘মীর-ই-ইমারত’ নামে পরিচিত ছিলেন। উত্তর ভারতের ঐতিহ্যবাহী ‘ক্যারাভ্যান সরাই’ অনুকরণে নির্মিত এই ইমারতটি প্রথমে ছিল এক বিশাল আয়তাকার প্রাঙ্গণকে ঘিরে, যার চারদিকে ২২টি কক্ষ ছিল। স্থাপত্যশৈলীতে বড় কাটরা ছিল অসাধারণ। দক্ষিণ অংশটি ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। তিনতলা উঁচু প্রবেশপথটি অষ্টভুজাকৃতির কেন্দ্রীয় কক্ষকে ধারণ করত, যার উপরে ছিল গম্বুজাকৃতি ছাদ। গম্বুজে পলেস্তরার উপর খোদাই করা লতাপাতার নকশা মুগ্ধ করত দর্শনার্থীদের। প্রবেশপথের দুই পাশে ছিল প্রহরীকক্ষ, আর মূল ভবনের কোণাগুলো অলংকৃত টাওয়ারে সজ্জিত ছিল। উনবিংশ শতকে প্রাচ্যবিদ জেমস অ্যাটকিনসন একে ‘গ্র্যান্ড ও সুন্দর আর্কিটেকচারের মজাদার স্তুপ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। কাটরার ব্যবহার ছিল বহুমুখী। শাহ সুজা নিজে এর উত্তর অংশে অবস্থান করতেন। পরবর্তীতে নওয়াব শায়েস্তা খাঁ এবং মীর জুমলা এখান থেকেই দেশ শাসন করেছেন। ১৭৬৫ সালে নিমতলী প্রাসাদ নির্মাণের আগে পর্যন্ত এখানেই দরবার বসত।
শাহ সুজা এটিকে সরাইখানা হিসেবে ব্যবহার করার দায়িত্ব দেন, যেখানে মুসাফিররা বিনামূল্যে থাকতে পারতেন। সরাইখানার ব্যয় নির্বাহের জন্য ২২টি দোকান ওয়াকফ করা হয়েছিল। এ তথ্য নিশ্চিত করেছে শিলালিপি, যেখানে লেখা ছিল যে এই বিধি কখনো বাতিল করা যাবে না, অন্যথায় বিচার দিবসে অপরাধীকে শাস্তি পেতে হবে। একসময় দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র ছিল বড় কাটরা। এর স্থাপত্যশৈলী নিয়ে বহু ভ্রমণকাহিনিতে উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু আজ বড় কাটরা কেবল ভগ্নপ্রায় স্মৃতিস্তম্ভ। মালিকানাগত জটিলতা এবং প্রতœতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ায় এটি সঠিকভাবে সংরক্ষিত হয়নি। উপরন্তু বর্তমান বাসিন্দাদের পরিবর্তনের কারণে এর মূল বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়েছে। বর্তমানে বড় কাটরা মাদরাসার তত্ত্বাবধানে রয়েছে। তবে আজকের দিনে এটি আর সেই জাঁকজমকপূর্ণ স্থাপত্য নয়, বরং ইতিহাসের একটি ক্ষয়ে যাওয়া দলিল মাত্র। তবুও এর ভগ্নাংশ আমাদের মনে করিয়ে দেয় বাংলায় মুঘল স্থাপত্যের শৌর্য, কারুকাজ ও শিল্পনৈপুণ্য।
চার্লস ডি অয়েলির আঁকা স্কেচ কিংবা পুরোনো বর্ণনা থেকে আজও বোঝা যায়, এককালে বড় কাটরা কতটা বৈশিষ্ট্যম-িত ছিল। অতীতের গৌরব আজ ধ্বংসাবশেষে পরিণত হলেও বড় কাটরা এখনো মুঘল স্থাপত্যকলার স্মারক হিসেবে ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়েছে।