কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা খালের দুই পাশে রয়েছে প্রায় ৪০০ ডেইরি ফার্ম। এসব ফার্মের রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার গরু। এসব ফার্মে প্রতিদিন তিন হাজার মেট্রিক টন গোবর ও দুই লাখ লিটার মূত্র উৎপন্ন হয়। মাত্র ৫০টি ফার্মে গোবর প্রক্রিয়াজাতকরণ ও অপসারণের ব্যবস্থা রয়েছে। বাকি ৩৫০টি ফার্মের বর্জ্য সরাসরি ফেলা হয় শিকলবাহা খালে। এতে খালটি এখন নোংরা ডোবা ও গোবরের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। খালে ফেলা বর্জ্য থেকে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়ায়। এই খালে মাছ নেই বললেই চলে। খালের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় উৎকট গন্ধে গা গুলিয়ে যায় পথচারীদের। একসময় শিকলবাহা খালের পানি দিয়ে স্থানীয়রা জমি চাষ করতেন। এখন দূষণের কারণে কৃষিতে এই পানি ব্যবহারের সুযোগ নেই।
নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে দিনের পর দিন প্রকাশ্যে ডেইরি কীভাবে শিকলবাহা খালে বর্জ্য ফেলছে? এই প্রশ্নের উত্তরে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, 'উপজেলা পর্যায়ে জনবল না থাকায় সব বিষয়ে নজর রাখা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তবে এর আগে আমরা খাল দূষণের পেছনে জড়িত কিছু ফার্ম মালিককে জরিমানা করেছিলাম। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট ছাড়া যারা কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেসব প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।' এর মধ্যে আবারও অব্যবস্থাপনার খবর নজরে এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'যারা নিয়মনীতি অমান্য করছে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কর্ণফুলী উপজেলার ছোট-বড় প্রায় ৬০০ ডেইরি ফার্মের অধিকাংশই শিকলবাহা ও চরলক্ষ্যা ইউনিয়নে। এসব ফার্মে দৈনিক তিন হাজার মেট্রিক টন গোবর ও দুই লাখ লিটার মূত্র উৎপন্ন হয়। এসব গোবর আর মূত্রের সিংহভাগ মেশে শিকলবাহা খালে।
রোববার সরেজমিন দেখা গেছে, অধিকাংশ ডেইরি ফার্মের গোবর ও মূত্রমিশ্রিত দূষিত পানি পাইপ ও ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি খালে ফেলা হয়, যা পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
স্থানীয় মো. নাজের আলীর বাড়ি চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডে। রোববার তিনি তার শিম গাছের পরিচর্যা করছিলেন। ডেইরি ফার্ম মালিকদের অব্যবস্থাপনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই ব্যক্তি। তিনি বলেন, 'জন্মের পর থেকে এই খাল আমাদের জীবনের অংশ ছিল। বছরের পর বছর এই খালে আমরা গোসল করেছি। খালে কাপড়চোপড় ধোয়াসহ দৈনন্দিন নানা কাজে খালের পানি ব্যবহার করতাম। পানি পুকুরের পানির মতো পরিষ্কার ছিল। কিন্তু গত ১০-১৫ বছর ধরে ডেইরি ফার্মের বর্জ্য ফেলায় খালটি ধ্বংস হয়ে গেছে। ফার্মের মালিকরা গরু ও দুধ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা আয় করেন।
শিকলবাহা ইউনিয়নের শাহ ইসলামিয়া ডেইরি ফার্মের মালিক হাবিবুর রহমান স্বীকার করেন, তার খামারের বর্জ্য খালে ফেলা হয়। একই কথা স্বীকার করেন আরেক ফার্ম মালিক মো. জসিম উদ্দীনও। হাবিবুর রহমান এবং জসিম উদ্দীনের দাবি, বর্জ্য পরিশোধনের কোনো বিকল্প না থাকায় মালিকরা গোবরমিশ্রিত দূষিত পানি সরাসরি খালে ফেলতে বাধ্য হন। তবে সাধারণ মানুষের বক্তব্য হলো যারা ফার্ম পরিচালনা করে অর্থ-উপার্জন করছেন, তাদেরই বর্জ্য অপসারণের ব্যবস্থা করা উচিত।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বিডব্লিউডিবি) আওয়াতাধীন শিকলবাহা খালটি এই জনপদকে বর্ষাকালে বন্যার পানি থেকে রক্ষা করে। এ ছাড়া কর্ণফুলী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার কৃষক তাদের সেচের পানি এ খাল থেকেই ব্যবহার করতেন। অথচ দূষণে মৃতপ্রায় এই খাল এখন কৃষকদের কোনো কাজেই আসছে না।
প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের ৯ মে শিকলবাহা খালকে দূষণমুক্ত করা ও ডেইরি ফার্ম থেকে সৃষ্ট বর্জ্য জৈব সার হিসেবে ব্যবহারে পরিকল্পনা নিয়ে একটি বিশেষ সভা চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। করা হয় একটি কমিটিও। সেই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মাসুদ কামাল। সভায় কর্ণফুলীর তৎকালীন ইউএনও শাহিনা সুলতানা ও বর্তমান উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রুমন তালুকদারও ছিলেন। খাল দূষণমুক্ত করতে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
স্থানীয়রা জানান, খালের দূষণ কমাতে গোবর থেকে জৈব সার তৈরির জন্য কর্ণফুলী উপজেলায় একটি কেন্দ্রীয় প্লান্ট নির্মাণ শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরে তা আলোর মুখ দেখেনি।
কর্ণফুলী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. রুমন তালুকদার বলেন, 'ডেইরি ফার্মের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আগেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। একটা সময় ফার্ম মালিকরা তাদের বর্জ্যগুলো খালে ফেললেও এখন তা কমে এসেছে। পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে তাদের সচেতন করা হয়েছে। এ ছাড়া, আমরা ফার্ম মালিকদের বর্জ্য পরিশোধনের জন্য বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনে উৎসাহিত করছি এবং এরই মধ্যে কিছু মালিক।'
কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সজীব কান্তি রুদ্র বলেন, 'কর্ণফুলী দেশের বৃহত্তর ডেইরি শিল্প। সারাদেশে এখান থেকে দুধ সরবরাহ হয়। তাদের সব সময় আমরা উৎসাহ দিয়ে থাকি। তবে ফার্ম মালিকদের উদাসীনতার কারণে পরিবেশের ক্ষতি কাম্য নয়। ফার্ম মালিকদের আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে ধারণা দেওয়া হয়েছে। ডেইরি ফার্মের বজ্য দিয়ে জৈব সার ও গ্যাস উৎপাদনের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। একটা সুশৃঙ্খল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শিগগিরই কাজ শুরু করা হবে।' শিকলবাহা খাল পুনরুদ্ধারে খাল খননের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানান ইউএনও মামুনুর রশীদ।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন