শীতের আগমনে বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার গ্রামাঞ্চলে ব্যস্ততা বাড়ে কুমড়ো বড়ি তৈরিতে। শীত মৌসুমই এ সুস্বাদু বড়ি বানানোর উপযুক্ত সময় হওয়ায় নিত্যদিনের সংসারের কাজ সামলেও সকালবেলা বড়ি তৈরিতে মেতে ওঠেন গ্রামের নারীরা। তরকারির স্বাদে ভিন্ন মাত্রা যোগ করা এই কুমড়ো বড়ির চাহিদাও এ সময় বাড়তে থাকে।
সরেজমিনে দেখা যায়, দুপচাঁচিয়া উপজেলার তালোড়া কইল গ্রামের নারীরা কুমড়ো বড়ি তৈরির কাজে জড়িত। শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ব্যস্ততা আরও বেড়েছে। বর্ষাকাল ছাড়া বাকি মাসগুলোতে কমবেশি কুমড়ো বড়ি তৈরি করা হয়। অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন, এই চার মাস কুমড়ো বড়ি তৈরির ধুম পড়ে যায়।
শীতকাল কুমড়ো বড়ি তৈরির ভরা মৌসুম। এ সময় গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে কমবেশি কুমড়ো বড়ি তৈরি করা হয়। কেউ পরিবারের চাহিদা পূরণ করে বাকিটা বাজারে বিক্রি করেন। শীতে কুমড়ো বড়ির চাহিদা থাকে বেশি, তাই নারীরা বাড়তি আয়েও সক্ষম হন।
কুমড়ো বড়ি তৈরির প্রধান উপকরণ মাসকলাইয়ের ডাল, কালোজিরা, চালের গুঁড়ো ও চালকুমড়া। বাজারে প্রতি কেজি মাসকলাই কাঁচা (খোসাসহ) ১৪০ টাকা, আর খোসা ছাড়া ১৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। চালকুমড়া ১৮০ থেকে ২৩০ টাকা পিস, সাইজ অনুযায়ী ৭০ থেকে ১০০ টাকায়ও পাওয়া যায়। ৫ কেজি চালকুমড়োর সঙ্গে ১০০ গ্রাম কালোজিরা ও ২ কেজি মাসকলাই মিশিয়ে কুমড়ো বড়ির মিশ্রণ তৈরি করা হয়।
প্রথমে মাসকলাই রোদে শুকিয়ে ঝাড়াই-বাছাই করা হয়। কেউ কেউ না ভেঙেও পানিতে ভিজিয়ে খোসা ছাড়ান। প্রায় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা মাসকলাই পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। এরপর ঢেঁকি বা শিল-পাটায় পিষে মিশ্রণ তৈরি করা হয়।
বর্তমানে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চাউলের গুঁড়ো করার মেশিনে মাসকলাই ও কুমড়ো মিহি করে বড়ির উপকরণ সহজেই প্রস্তুত করা হচ্ছে।
রৌদ্রোজ্জ্বল খোলা স্থান- বাড়ির আঙিনা, ছাদ কিংবা ফাঁকা জায়গায় ভোর থেকে বড়ি তৈরি শুরু হয়। পাতলা কাপড়ের ওপর সারি সারি বড়ি বসানো হয়। বড়ি বসানোর পর দুই-তিন দিন টানা রোদে শুকানো হয়। রোদ কম হলে ৩-৪ দিনও লাগতে পারে। শুকানোর পর কাপড় থেকে বড়ি উঠিয়ে পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়।
দুপচাঁচিয়া পৌর এলাকার কালিতলা, লক্ষীতলা, তালোড়া শাবলা, ঠাকুরপাড়া কইলগ্রাম, জিয়ানগর ইউনিয়নের বাঁকপাল হিন্দুপাড়া- এসব এলাকায় প্রায় ৩০-৪০টি পরিবার বাণিজ্যিকভাবে কুমড়ো বড়ি তৈরি করছেন।
লক্ষীতলার নারী কারিগর ভারতী রানী বলেন, আগে কুমড়ো বড়ি ব্যবসায়ী পরিবারগুলো খুব স্বচ্ছল ছিল না। এখন অনেকেই কুমড়ো বড়ির ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
তিনি জানান, ৫ কেজি কুমড়ার সঙ্গে ২ কেজি মাসকলাই মিশিয়ে ভালো বড়ি তৈরি হয়। আগে মাসকলাই ভিজিয়ে খোসা ছাড়ানো, ঢেঁকিতে বা পাটায় বাটা—সব মিলিয়ে প্রচুর পরিশ্রম লাগত। এখন বাজারে খোসা ছাড়া মাসকলাই পাওয়া যায় এবং মেশিনে মাড়াই করায় সময় কম লাগে।
এক কেজি কুমড়ো বড়ি তৈরি করতে প্রায় ২৮০ টাকা খরচ হয়। ভালো মানের বড়ি বানাতে খরচ পড়ে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা, আর বিক্রি হয় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা দরে, যা দিয়ে নারীরা পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি আয় করতে পারছেন।
পৌর এলাকার কুমড়ো বড়ি ব্যবসায়ী শ্যামসুন্দর মোহন্ত ও অসীম বসাক বলেন, এখানকার কুমড়ো বড়ি খুব সুস্বাদু হওয়ায় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। বিশেষ করে ঢাকায় এর চাহিদা বেশি।
তারা জানান, সারা বছরই বড়ি বানানো সম্ভব হলেও শীতকালে এর কদর সবচেয়ে বেশি। কৈ মাছ, শিং মাছ, শৈল মাছ—এসবের সঙ্গে রান্না করলে এর স্বাদ আরও বেড়ে যায়। বড়ি বানানো থেকে শুরু করে সব কাজই এখানকার মেয়েরা বা নারী শ্রমিকরা করেন, এবং তাদের মজুরিও তুলনামূলক কম।
এ বিষয়ে জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল আবেদীন বলেন, শীত মৌসুমে গ্রামের নারীরা কুমড়ো বড়ি তৈরি করে বাড়তি আয় করছেন। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এসব নারী নিজেদের ভাগ্যোন্নয়ন এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে আরও বড় অবদান রাখতে সক্ষম হবেন।



সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন