২০ জুলাই সকাল। গাজীপুরের কাপাসিয়ার কীর্তুনিয়া গ্রামে হঠাৎ এক আর্তনাদে কেঁপে উঠল জনপদ। স্কুল দপ্তরি আরিফ হোসেন (৩২) ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। পাশের লোকজন ছুটে এলেও, বাঁচানো গেল না তাকে। একই দিনে আরও দুইটি খুনের ঘটনা গাজীপুরবাসীকে হতবাক করে তোলে- কালীগঞ্জ বাইপাস সড়কে ছিনতাইকারীর ছুরিতে ঝরে যায় অটোচালক আনোয়ার হোসেনের (৫৫) প্রাণ, আর কোনাবাড়ীতে কারখানার কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম (৪৮) খুন হন রহস্যজনক পরিস্থিতিতে।
গাজীপুর জেলা ও মহানগরীতে জানুয়ারি থেকে জুলাই- মাত্র সাত মাসেই ১০০-এরও বেশি মানুষ খুন হয়েছেন। গাজীপুর জেলার পাঁচটি থানায় ৫৯টি, মহানগর এলাকায় ৪১টি হত্যা মামলা রুজু হয়েছে বলে জানায় পুলিশ। অধিকাংশ হত্যার নেপথ্যে রয়েছে পারিবারিক কলহ, জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্ব, মাদক ও পরকীয়া সম্পর্ক।
গত ২৭ মে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাসির উদ্দিন পালোয়ান ও তার পরিবারের ৬-৭ জন সদস্যের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা। এক পর্যায়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নাসির উদ্দিন পালোয়ানকে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ৩৫ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তিনি মারা যান।
১১ জুলাই রাতে টঙ্গীতে কারখানায় কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন কলেজ শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান। পথে ছিনতাইকারীরা তার মোবাইল-মানিব্যাগ চাইলে তিনি প্রতিবাদ করেন। জবাবে ছুরির আঘাতে রক্তাক্ত হয় তার দেহ। হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই প্রাণ চলে যায় তার। শুধু তিনিই নন- এভাবে ১৭ মে রঞ্জু নামের এক যুবক খুন হন টঙ্গী ফ্লাইওভারে।
বিচারের হাত ছুঁয়ে যাওয়ার আগেই ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে মানুষকে। গত ১৮ জুলাই কাপাসিয়ার সেলদিয়া গ্রামে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে দিনদুপুরে পিটিয়ে মারা হয় মো. নূরুল ইসলামকে। আবার ২৮ জুন কোনাবাড়ীর গার্মেন্টসে চোর সন্দেহে ১৯ বছর বয়সী হৃদয় মিয়াকে হাত-পা বেঁধে মারা হয় নির্মমভাবে।
সম্প্রতি চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় গত বৃহস্পতিবার রাতে চাপাতির কোপে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সাংবাদিক মো. আসাদুজ্জামান তুহিনকে। একদিন আগেই সাংবাদিক আনোয়ার হোসেনকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। তার পা থেঁতলে দেওয়া হয়েছে ইটের আঘাতে। সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ- কেউই বাদ যাচ্ছেন না।
শুধু খুন নয়- গভীর বন কিংবা রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে অজানা লাশ। অনেকেই নিখোঁজ, পরিচয়হীন। পুলিশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করছে যাদের। এক ধরনের ‘নিরাপদ ময়লা ফেলার স্থান’ হয়ে উঠেছে এই অঞ্চল খুনিদের কাছে।
গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার চৌধুরী মো. যাবের সাদেক বলেন, ‘গত ১৭ বছরে দেশের একটা প্রজন্ম নষ্ট হয়ে গেছে। মূল্যবোধ নেই, সামাজিক অবক্ষয় হয়েছে। আইন বলেও কিছু আছে- এই বোধটাই নেই অনেকের মাঝে।’
এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মমিনুল ইসলাম আরও স্পষ্ট করে বলেন, ‘সামাজিক বিচ্যুতি, পরিবারভিত্তিক শাসনের অনুপস্থিতি এবং পুলিশ প্রশাসনের দুর্বলতাই এই ভয়ংকর চিত্রের পেছনে দায়ী।’
আপনার মতামত লিখুন :