ভোর পেরোনোর আগেই সরব হয়ে ওঠে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। এক পাশে সারি সারি ভ্যান, অন্য পাশে থেমে থাকা ট্রাকের বহর। ট্রলিতে চাপানো গাঁটের পর গাঁট নামছে-উঠছে—এ যেন রাতের আঁধারে শুরু হওয়া কাপড়ের উৎসব।
এ দৃশ্য ভুলতার গাউছিয়া মার্কেটের। সপ্তাহের একদিন—মঙ্গলবার, আর সেই দিনেই জমে ওঠে দেশজুড়ে খ্যাত ‘লক্ষীর হাট’। নারীর পায়ের পদচারণায় মুখরিত হয় গোটা মার্কেট। প্রায় ৩০ হাজার নারী এসে জড়ো হন, পাইকারি দামে কাপড় কিনে ফিরে যান নিজেদের এলাকায়। কেউ ফেরি করেন, কেউ চালান নিজস্ব দোকান। কিন্তু সবাই মিলে গড়ে তোলেন আত্মনির্ভরতার এক বাস্তব গল্প।
১৯৭৯ সালে ক্ষুদ্র পরিসরে যাত্রা শুরু করা এই বাজার এখন দেশের অন্যতম বৃহৎ তাঁতবস্ত্র বিপণন কেন্দ্র। ১২০ বিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠা গাউছিয়া মার্কেটে রয়েছে আট হাজারের বেশি দোকান। প্রতিটি দোকানে চলে কাপড়ের পাইকারি কেনাবেচা।
শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, ওড়না, থ্রি-পিস, জামদানি থেকে শুরু করে থান কাপড়—কী নেই এখানে! মঙ্গলবার এলেই প্রায় ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার বেচা-কেনা হয়।
গাউছিয়া হাটের সবচেয়ে চমকপ্রদ দিক হলো, এই হাটে নারীদের স্বাচ্ছন্দ্যে আনাগোনা। শুধু কেনা-বেচার বাজার নয়, এটি হয়ে উঠেছে অসংখ্য নারীর স্বপ্ন বুননের মঞ্চ।
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরিপুর এলাকার জোসনা বেগম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘গত ২০ বছর ধরে এখান থেকে কাপড় কিনে ফেরি করে বিক্রি করেন নিজের এলাকায়। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনিই সংসারের হাল ধরেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘গ্রামের নারীরা খুব বেশি মার্কেটে গিয়ে কাপড়চোপড় কেনেন না। আর দোকানে তুলনামূলক দাম বেশি থাকে। সে কারণে তিনি গ্রাম ঘুরে ঘুরে কাপড় বিক্রি করেন। সপ্তাহে অন্তত দেড়-দুইশো থ্রি-পিস বিক্রি করেন। খরচ বাদে ৮-১০ হাজার টাকার মুনাফা হয় তার।’
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি এলাকার শেফালী বেগমের গল্পও একই রকম। স্বামী মারা যাওয়ার পর একাকিত্ব, দারিদ্র্য ও দিশাহীনতা যখন এক সঙ্গে আক্রমণ করেছিল, তখন গাউছিয়া মার্কেটই হয়ে ওঠে তার আশ্রয়। এখন তার নিজস্ব ব্যবসা আছে, এমনকি কিছু জমিও কিনেছেন।
যশোরের নওয়াপাড়া এলাকার হোসনে আরা, পিরোজপুরের খায়রুন, পটুয়াখালীর নূরজাহান এরা সবাই এক-একটি জীবন্ত প্রমাণ, কীভাবে একটি হাট নারীর জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসতে পারে।
আড়াইহাজারের বিশনন্দি এলাকার জুলেখা আক্তার রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ‘আগে ডাল-ভাত জোটানো কষ্ট ছিল। এখন কাপড় বিক্রি করে সংসার চালাই, মেয়ের পড়াশোনার খরচও দিই।’
গাউছিয়া শুধু বাজার নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক ঘটনাও। প্রতিটি মঙ্গলবার এখানে যেন ঈদের আমেজ। রাত থেকেই শুরু হয় প্রস্তুতি। মহাসড়কজুড়ে ট্রাক, ভ্যান, কুলির কণ্ঠে হাঁকডাক, দরদাম, বস্তা ওঠানো-নামানো—সব মিলিয়ে এক গন্তব্যহীন ব্যস্ততা, যেন বস্ত্র বণিকদের মিলনমেলা।
নারী ক্রেতাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে কাজ করে মার্কেট কর্তৃপক্ষ। রয়েছে স্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি, সিসিটিভি ক্যামেরা, নিরাপত্তা প্রহরী। ফলে চুরি-ছিনতাইয়ের ভয় প্রায় নেই বললেই চলে। পাশাপাশি মার্কেটকে ঘিরে বাংলাদেশের প্রায় সব ব্যাংকের শাখা রয়েছে গাউছিয়াতে, যার ফলে আর্থিক লেনদেনও নিরাপদ।
সবকিছুই শুধু আলোয় মোড়া নয়। বাজারে থাকা দোকানিরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক চাপ কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে বেচাকেনা।
‘বিসমিল্লাহ শাড়ি বিতান’-এর মালিক সহিদুর ইসলাম বলেন, ‘আগে ৪-৫ লাখ টাকা বিক্রি হতো মঙ্গলবারে। এখন সেটা নেমে এসেছে ১-২ লাখের কাছাকাছি। তবে এই হাটের প্রতি বিশ্বাস এখনো অটুট।’
‘সিটি প্রিন্ট’-এর মালিক বলেন, ‘যতই বাজার মন্দা হোক, মঙ্গলবার এলে নতুন আশার আলো দেখি।’
গাউছিয়া মার্কেটের মালিক মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘তার বাবা মুজিবর রহমান ভূঁইয়া এই বাজার শুরু করেন। বর্তমানে গাউছিয়া-১ এবং গাউছিয়া-২-এর পাশাপাশি ‘সিটি মার্কেট’ ও ‘টিনশেড বাজার’ নামে আরও দুটি নতুন মার্কেট চালু হয়েছে।’
তিনি আরও জানান, ‘যেহেতু এটি এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি কাপড়ের বাজার এবং ৪০ শতাংশের অধিক ক্রেতা নারী, তাই তাদের জন্য কম খরচে মহিলা রেস্ট হাউস বানানোর পরিকল্পনা করেছি। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের জন্য আবাসিক অ্যাপার্টমেন্টও নির্মাণ করব।’
বাজার মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ মাসুদ ভূঁইয়া জানান, ‘আমাদের বাজারে গত ৪৬ বছরে কোনো নারী ক্রেতার সম্মানহানি বা নিরাপত্তা ঘাটতির ঘটনা ঘটেনি। আমরা নারীদের জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি নারীদের অধিক নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত নারী নিরাপত্তাকর্মী নিয়োজিত রয়েছে।’
আপনার মতামত লিখুন :