রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ৬০টি ওয়ার্ডে বর্তমানে ৩৩৩ জন চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করছেন। কমপক্ষে ৪০০ জন চিকিৎসক প্রয়োজন। তবেই কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা যাবে। ফলে চিকিৎসক সংকটে রামেক হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
২১টি ওয়ার্ডেই বিভাগীয় প্রধান বা অধ্যাপক (বিশেষজ্ঞ) চিকিৎসক পদ শূন্য রয়েছে। এতে রোগীদের চিকিৎসাসেবা এবং ইন্টার্নদের প্রশিক্ষণ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ পদগুলো পূরণের জন্য মন্ত্রণালয়ে একাধিবার চিঠি দেওয়া হলেও সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে হাসপাতালের রোগী ও চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাঝেও রয়েছে অসন্তোষ।
এ ছাড়াও আরও দুটি ওয়ার্ডে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে দুজন অধ্যাপক অবসরে যাবেন। তখন এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২৩ জনে। সর্বশেষ রোববার (১০ আগস্ট) অবসরে গেছেন হাসপাতালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওয়ার্ড কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, উত্তরবঙ্গের চিকিৎসা ক্ষেত্রে রাজশাহী একটি অন্যতম হাসপাতাল। এ ছাড়া কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা জেলা থেকেও রাজশাহী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন হাজার রোগী। প্রতিদিন গড়ে এ হাসপাতালে বর্হিবিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হয় ৫ হাজার রোগীকে। আর ভর্তি রোগী থাকেন গড়ে তিন হাজার।
কাগজে-কলমে এ হাসপাতালটি ১২শ শয্যার হলেও সেখানে জনবল রয়েছে ৫০০ শয্যার। এতে এমনিতেই চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসক নার্সদের। এর মধ্যে বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিভাগীয় প্রধান বা অধ্যাপক পদ শূন্য থাকায় চিকিৎসাসেবা আরও চরম সংকটের মুখে পড়েছে।
হাসপাতাল সূত্র মতে, রামেক হাসপাতালের সার্জারি, ইউরোলজি, বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি, নিউরো সার্জারী, শিশু সার্জারী, ক্লিনিক্যাল নিউরো সার্জারী, অর্থোপেডিক সার্জারি, চক্ষু, নাক-কান-গলা ও নেক সার্জারী, রিউমোটলজি, হেমাটলজি, হেপাটলজি, গ্যাস্ট্রএন্টারোলজি, নিউরো মেডিসিন, ফিজিক্যাল মেডিসিন, মানসিক ব্যাধি, ডার্মাটলজি, নিওনেটলজি, পেডিয়াটিক হেমাটলজি অ্যান্ড নকোলজি ও রিমোভেবল অর্থোপেডিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান বা অধ্যাপক পদ শূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এর মধ্যে সর্বশেষ রোববার (১০ আগস্ট) অবসরে গেছেন কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক পদ শূন্য হয়।
এ ছাড়াও আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর অবসরে যাবেন রেডিও থেরাপী এবং ৩০ ডিসেম্বর অবসরে যাবেন রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের অধ্যাপক। ফলে আরও দুটি পদ শূন্য হবে। কিন্তু এসব পদ পূরণে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে সর্বশেষ গত ১৫ মে চিঠি দিয়ে এসব পদ পূরণের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করেছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফএম শামীম আহমেদ। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। ফলে অধ্যাপক শূন্য হওয়া ওয়ার্ডগুলোতে চিকিৎসাসেবা এবং চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এমনকি এফসিপিএস কোর্স সম্পন্ন করতেও মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে।
রামেক হাসপাতাল সূত্র আরও জানায়, ইন্টার্ন চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ ছাড়াও এখানে রয়েছে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও মিডলেভেল চিকিৎসদের জন্য এফসিপিএস কোর্স। সব মিলিয়ে সার্বক্ষণিক ৩৩৩ জন চিকিৎসক অংশ নেন। অধ্যাপক পদ শূন্য থাকায় তাদের প্রশিক্ষণও সম্পন্ন করতে পারছেন না।
হাসপাতালের নিউরো মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসারত রোগীর স্বজন ইমরান আলী বলেন, ‘বড় স্যাররা তো দিনে একবার আসেন। রোগীর চিকিৎসা ঠিকমতো হয় না। যা করেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা করেন।’
হাসপাতালের নিউরো সার্জারি ওয়ার্ডের রোগীর স্বজন আলতাফ হোসেন বলেন, ‘আমার রোগীর অপারেশন লাগবে। গত সপ্তাহে হবে বলেছিলেন চিকিৎসক। কিন্তু হয়নি। এখন বলছেন সামনে সপ্তাহে করাবেন। সিরিয়াল নাকি পাইনি আমার রোগী।’
এ প্রসঙ্গে রামেক হাসপাতালের পরিচালকের মুখপাত্র ডা. সংকর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালানোর পরেও বিভিন্ন ওয়ার্ডে অধ্যাপক বা বিভাগীয় প্রধান শূন্য থাকায় চিকিৎসাসেবাতে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। এখানে কমপক্ষে ৪০০ জন চিকিৎসক প্রয়োজন। আছেন ৩৩৩ জন। এর ওপর জুনিয়র এবং মিডলেভেলের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ এবং এফসিপিএসের সংকট তৈরি হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে অবগত করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ফলাফল আসেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অভিজ্ঞ চিকিৎসক। অধ্যাপকদের জ্ঞানের ভান্ডার জুনিয়র বা মিডলেভেলের চিকিৎসকদের চেয়ে অবশ্যই ভালো হবে এটাই স্বাভাবিক। ফলে মুমূর্ষু রোগীদের সেবার ক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্ত অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু এসব পদই যদি শূন্য থাকে, তাহলে উন্নত চিকিৎসাসেবা সঠিকভাবে হবে না এটাই বাস্তবতা। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি।’