ঢাকা মঙ্গলবার, ০২ ডিসেম্বর, ২০২৫

রাজশাহীর ‘নাগা বাজার’ যুগান্তরের গল্প

রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২, ২০২৫, ০২:০৫ পিএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার কাতিলা গ্রামের হৃদপিণ্ডে গড়ে উঠেছে ‘নাগা বাজার’। প্রাণচঞ্চল এই বাজারের জন্মকাহিনি শুধু একটি স্থানের নামকরণের ইতিহাস নয়; এটি একটি পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও মূল্যবোধের এক অনন্য উদাহরণ। এই বাজারের নামকরণের পেছনে রয়েছে দুজন মানুষের অসামান্য অবদান। তারা হলেন- মো. গহের আলী মণ্ডল ও তার সহধর্মিণী মোসা. নাসিমা বেগম। তাদের জীবনের সংগ্রাম, পরিশ্রম, সততা ও মানবিকতা কাতিলা গ্রামের মানুষের কাছে এক প্রেরণার গল্প হয়ে আছে, যা পরবর্তী প্রজন্মকে পথ দেখায়।

মো. গহের আলী মণ্ডলের জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৪০ সালে এক সাধারণ কৃষক পরিবারে। মোসা. নাসিমা বেগম জন্মগ্রহণ করেন ১ মে ১৯৪২ সালে। ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০ সালে গহের আলী মণ্ডল ও নাসিমা বেগমের বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহের পর তারা গড়ে তোলেন এক শিক্ষার পরিবেশ, নৈতিকতার পরিবার। তাদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। দুই ছেলে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত এবং তাদের পিতামাতার নাম ও স্মৃতি ধরে রাখতে জীবনপথে এগিয়ে চলেছেন। বাবা মায়ের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে বাজারে নাম করেছেন না (নাসিমা) + গা (গাহের)= নাগা বাজার।

১৯৯০-এর দশকে যখন স্থানীয়ভাবে একটি বাজার স্থাপনের ভাবনা আসে, তখন তাদের সন্তানরা পরিবারের ঐতিহ্য ও স্মৃতি ধরে রাখতে এই সুন্দর ও ব্যতিক্রমী নামটি প্রস্তাব করেন। পরবর্তীতে এই ‘নাগা বাজার’ নামটিই স্বীকৃত হয় এবং ধীরে ধীরে এটি বর্তমানে জনপ্রিয় বাজার হিসেবে গড়ে ওঠে। ২০২৪ সালের ৫ জানুয়ারি রোজ শুক্রবারের দিন ‘নাগা শপিং এন্ড সার্ভিস সেন্টার’-এর উদ্বোধন কালে এই বাজারটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। 

‘নাগা বাজার’ নাম করনে মো. গাহের আলী মন্ডল ও মোসা. নাসিমা বেগমের উপস্থিতিতে অত্র এলাকার জনগণের উপস্থিতি, সার্বিক সহযোগিতা ও পূর্ণ সমর্থনে এই বাজারের নামকরণ হয়। 

১৯৯০-এর দশকে শুরু হওয়া নাগা বাজার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নতি ও সম্প্রসারণ লাভ করতে থাকে। প্রাথমিকভাবে এটি ছিল একটি ছোট ও সীমিত কার্যক্রমের বাজার। কিন্তু স্থানটি ছিল কাতিলা গ্রামের কেন্দ্রস্থলে কাতিলা খালের(ডাড়ি) বুকে- যা পরবর্তীতে বাজারের প্রসারের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে নাগা বাজার শুধু একটি ব্যবসায়িক কেন্দ্র নয়; এটি মানুষের মিলনস্থল, যোগাযোগ কেন্দ্র এবং গ্রামীণ অর্থনীতির প্রধান চলক। এখানে প্রতিদিন সকাল-বিকেল শত শত মানুষ কেনাকাটার জন্য আসেন। বিশেষ করে সকালে কাতিলা বিলসহ আশেপাশের জলাভূমি থেকে আসা তাজা মাছ বাজারটির প্রধান আকর্ষণ।

তাজা সবজি, ধান-চাল, হাঁস-মুরগি সহ স্থানীয় কৃষিজ পণ্যের সুলভ ও মানসম্মত এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে নাগা বাজারের খ্যাতি দিন দিন বাড়ছে।

কাতিলা একটি বৃহৎ গ্রাম, যার গঠন ‘L’ আকৃতির। এই গ্রামের ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত নাগা বাজার। এখান থেকে তিন দিকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা বিস্তৃত হয়েছে- উত্তরে: নাগা বাজার–(মুলিভিটা/ মৌলভীভিটা) সড়ক, পশ্চিমে: নাগা বাজার–ভবানীগঞ্জ সড়ক, দক্ষিণে: নাগা বাজার–বীরকুৎসা সড়ক। এই ত্রিমুখী সংযোগের জন্যই নাগা বাজার দ্রুতই আশেপাশের গ্রামের মানুষের প্রধান গন্তব্য হয়ে ওঠে।

নাগা বাজারের উত্তরে যে অংশটি রয়েছে তা ‘নিচু কাতিলা’ হিসেবে পরিচিত এবং পশ্চিম দিকের অংশটি ‘উপর কাতিলা’ নামে পরিচিত। এই দুই এলাকার মাঝে নাগা বাজারই হচ্ছে একমাত্র কার্যকর কেন্দ্রবিন্দু। যাতায়াত, বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক কর্মকাণ্ড- সবক্ষেত্রেই বাজারটি দুই অঞ্চলের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছে।

নাগা বাজার ব্রিজের সংযোগ- কাতিলা ও গোপীনাথপুর গ্রামের বন্ধন ও নাগা বাজারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। কিনুরমোড় এই নামকরণ করা হয়েছিল মরহুম আজিজার রহমান কিনু-এর অবদানের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। 

শিক্ষা, ধর্ম ও প্রশাসনিক অবকাঠামো নাগা বাজারকে ঘিরে রয়েছে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যা বাজারকে আরও বেশি প্রাণবন্ত করেছে। এর আশেপাশে রয়েছে- দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ বিদ্যালয়, একটি কলেজ। এছাড়াও রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ, ডাকঘর, দুটি মাদ্রাসা, দুটি ঈদগাহ মাঠ, ছয়টি মসজিদ, একটি গ্রামীন টাওয়ার যা নাগা বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত একটি খাল যা কাতিলা গ্রামের দক্ষিণ পাশ ও পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে দুটি হিন্দুদের মন্দির।

এতগুলো শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান একটি গ্রামের উন্নত সামাজিক কাঠামোর পরিচয় দেয়। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ ও পোস্ট অফিস থাকার কারণে নাগা বাজার হয়ে উঠেছে  অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।

নাগা বাজার অর্থনৈতিকভাবে আশেপাশের বহু গ্রামের মানুষের উপর নির্ভরশীল কেন্দ্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রামগুলো হলো- নখোপাড়া, ভাগনদি, কোলা, শান্তিপুর, বীরকুৎসা, বনগ্রাম, মাধাইমুড়ি, কাতিলার উত্তর ও পশ্চিমাংশ। এইসব গ্রামের মানুষ প্রতিদিন প্রয়োজনীয় বাজার করতে এখানে আসেন। বিশেষ করে  অনেকেই ভোরের আলো ফোটার আগেই বাজারে চলে আসেন তাজা মাছ কেনার জন্য।

মানবিকতার প্রতীক: গহের আলী ও নাসিমা বেগম পরিবার নাগা বাজার শুধু একটি বাণিজ্য কেন্দ্র নয়; এটি গহের আলী মণ্ডল ও নাসিমা বেগম দম্পতির প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন।

গ্রামীণ অর্থনীতি, সামাজিক সম্পর্ক, শিক্ষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি- সব ক্ষেত্রেই নাগা বাজারের ভূমিকা অপরিসীম। এটি শুধু একটি বাজার নয়; এটি একটি গ্রামের ঐতিহ্য, মানুষের স্মৃতি ও উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি।