বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


নাঈম রহমান

প্রকাশিত: জুন ৩, ২০২৫, ০৬:২৯ পিএম

এক ফোঁটা কেরোসিন

নাঈম রহমান

প্রকাশিত: জুন ৩, ২০২৫, ০৬:২৯ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

সারা ঘর তন্নতন্ন করে কী যেন খুঁজছে সাব্বির। ঘরের ভেতর তেমন কিছু নেই। একপাশে কাঠের একটা টেবিল আর ঘুনে ধরা ২-৩টি চেয়ার। আরেক পাশে পুরোনো একটা আলমারি। খোঁজাখুঁজি এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মা ঘরে নেই। দু-তিন কিলোমিটার দূরে কোনো এক চেয়ারম্যানের বাড়িতে নাকি কাপড় বিতরণ করা হবে, সে উদ্দেশ্যে ভোর বেলায় বেরিয়ে গেছেন।

বাবা মারা গেছে সবেমাত্র ৪ মাস হলো, বাবা থাকতে তাও এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে খাবারের ব্যবস্থা করত, এখন মা-ই একমাত্র ভরসা। মা তাকে চাইলে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু নেয় না এক কারণে, গেরস্থের বাড়িতে কোনো মজার ফল অথবা খাবার দেখলে খেতে বায়না ধরে। মা পেটের দায়ে হাত পাতে তবে কারো কটু কথা শুনলে তার বুক ফেটে যায়। আজকে মা বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলেছিল চুপচাপ ঘরে থাকলে ২ টাকা পুরস্কার পাবে।

কিন্তু ৭ বছর বয়সী দূরন্ত সাব্বির এতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারে না। সকাল থেকে এরমধ্যে ৫-৬ জন আইসক্রিমওয়ালা হাঁক মেরে বিদায় নিয়েছে। প্রথমে সহ্য করে থাকলেও এখন তাদের অনবরত হাঁকে সাব্বিরের আর সইছে না। চিন্তা করল ঘরে খোঁজাখুঁজি করলে অন্তত ২ সিকি হলেও পাওয়া যাবে।

পুরোনো আলমারির খুঁটি ধরে দেখতে চেয়েছিল ওপরে কিছু আছে কি না, ওমনি ধপাস করে ছিটকে পড়ল মাটিতে। মা এসে দেখে ওমনিই পড়ে আছে সাব্বির। একটু ব্যথা পেলেও হয়তো-বা অভিমানের চোটেই সে আর মাটি থেকে ওঠেনি। মা এসে বুকে জড়িয়ে ধরল, আর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা পানি।

সেদিন সন্ধ্যায় সাব্বিরের মা মাগরিবের নামাজ পড়তে জায়নামাজে বসল। নামাজ শেষ করে যখন মোনাজাত ধরবে, ঠিক তখনই চোখ পড়ল আলনার চিপায়, অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে একটা বুটজুতা। আরেকটা নাই, মানুষ না থাকলে আসলে এসবের কখনো ঠিক থাকে না। বুটজুতার দিকে তাকিয়ে  হঠাৎ-ই সাব্বিরের মা কল্পনাপ্রবণ হয়ে পড়লেন। এ বুটজুতা সাব্বিরের বাবা পরতেন বর্ষাকালে সাপ, জোঁক থেকে রক্ষা পাবার জন্য।

সারাদিন মাঠেঘাটে থাকতেন। বৃষ্টিতে কলাপাতা মাথায়, বুটজুতা পায়ে দুয়ারে এসে হাঁক মারতেন, কই গো... কারেন্টের জালে দুটো কই মাছ পাইছি। আবার কখনো বুনো কলমিশাক এনে বলতেন, ডোবায় এবার যা কলমি হইছে, আমাগো পুরো বর্ষা চলে যাবে। নাহ... সাব্বিরের মায়ের আর কষ্ট সহ্য হচ্ছে না। তাড়াতাড়ি মোনাজাত শেষ করে সাব্বিরকে ডেকে বলল, যাহ এই জুতাখানা পানিতে ফেলে দিয়ে আয়। সাব্বির অসহায়ত্বের সুরে বলল, ও মা এইডা ফালামু ক্যান!? এইডা দিয়া তো অনেকখানি কটকটি খাইতে পারুম।

মা মেজাজের সুরে বললেন, আইচ্ছা খাইচ তোর কটকটি, এখন আমার সামনে থে থেকে সরা। রসুইঘরের পেছনে নারকেল গাছের চিপায় রাইখা দিয়া আয় যাহ। কাপড়ের আঁচল দিয়ে শক্ত করে দুচোখ আটকে রাখলেন। সাব্বিরের মায়ের এমন বুকফাটা কান্না গোপনই থেকে গেল।

সাব্বিরের মায়ের এই জীবন অন্য সবার মতো নয়। অল্প বয়সেই বিধবা হয়ে যেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আসামি মনে হয় নিজেকে। একমাত্র সম্বল সাব্বির। সারা দিনের ছোটাছুটির পর রাতে যখন বুকের মধ্যে সাব্বিরের ছোঁয়া পান, তখন সব ভুলে গিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেন না। 
 
কিছুদিন পরই কোরবানির ঈদ। সাব্বিরের বাবা যখন বেঁচে ছিলেন, তখন কোরবানির ঠিক আগ মুহূর্তে বাবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে গরু দেখত সাব্বির। ঈদের দিন কোন কোন জায়গা থেকে গোশত নিয়ে আসতেন সাব্বিরের বাবা। এবার কি হবে? সাব্বিরের মনেও মাঝেমধ্যে ভাসে বাবার সঙ্গে গরু দেখবার স্মৃতি। এক-দুটি করে কোরবানির গরুর আনাগোনা আশপাশে। সাব্বির তার মায়ের কাছে ভীষণ বায়না ধরে কিন্তু তার মা কোনোভাবেই তাকে একা রাস্তাঘাটে ছাড়তে রাজি নয়। তাই মাঝেমধ্যে মা বাধ্য হয়েই সঙ্গে করে গরু দেখিয়ে নিয়ে আসে, কিন্তু সবসময় সম্ভব হয় না। সম্ভব হবেই বা কী করে! সংসারের পুরো দায়িত্ব যে সাব্বিরের মায়ের ওপর। 

ঈদ আসছে, চারপাশে ছেলেপেলেরা বাজি ফুটিয়ে আনন্দ করে। নানারকম বাজি, তবে সস্তায় একটা বাজি পাওয়া যায়, দাম মাত্র পাঁচ টাকা। সাইকেলের রিংয়ের সঙ্গে যে স্টিলের পিনটি আষ্টেপৃষ্টে থাকে, সেই পিনের বাজি। পিনের ক্ষুদ্র ছিদ্রের মধ্যে দিয়াশলাইয়ের বারুদ ঢুকিয়ে শক্ত কোনো জায়গায় আঘাত করে ফোটাতে হয়। কিন্তু অভাবের সংসারে সাব্বিরের মায়ের কাছে ৫ টাকাও ৫০০ টাকার মতো। কোথা থেকে দৌড়ে এসে ধপাস করে মায়ের কোলে পড়ল সাব্বির।

মা তো বুঝেই গেছে একটা আবদার নিয়েই এসেছে তার আদরের সন্তান সাব্বির। প্রথমে ভেবেছিলেন সাব্বিরের হয়তো ঈদে নতুন জামার আবদার। কাঁচুমাচু হয়ে সাব্বির বলল, মা একটা বাজি কিনে দাও। সাব্বিরের মা কিছু না ভেবেই জানতে চাইল, কয় টাকা বাজির দাম? মায়ের কোল থেকে মুখ উঁচিয়ে মায়ার হাসি হেসে উত্তর দিল ৫ টাকা। এবার হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সাব্বিরের মা।

ঈদের আগ মুহূর্তে কত জায়গায় বড় লোকেরা গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করে। কিন্তু সাব্বিরকে একা রেখে কোথাও যেতে সাব্বিরের মায়ের সাহস করে না। তাই আজকে ৫ টাকার জন্য সাব্বিরকে একটা শর্ত জুড়ে দিল তার মা। আজকে তার মা একটু দূরের গ্রামে জাকাতের সন্ধানে যাবে, মাকে দুষ্টুমি ছাড়া সঙ্গ দিলেই শুধু বাজির ৫ টাকা পাওয়া যাবে। দুরন্ত সাব্বিরও একগাল হেসে দিয়ে মায়ের শর্তে রাজি হয়ে গেল। 

সকালে দুমুঠো পান্তাভাত খেয়ে মায়ের পিছু ধরল সাব্বির। আবহাওয়া খুব বেশি ভালো না। এবার ঝড়-বাদলের দিনে হবে কোরবানির ঈদ। হঠাৎ-হঠাৎ-ই বৃষ্টি হয়, ঝড় হয়। সকাল থেকে রোদ নেই, আবার বৃষ্টিও হচ্ছে না। আকাশের গুমোট ভাব যেন ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। সাব্বিরের মায়ের মনে ভয়, আকাশের এই অবস্থা ভালো কোনো লক্ষণ নয়। অর্ধেক পথ যেতেই আরও অন্ধকার, অথচ বাজে দুপুর ১২টা। এবার সাব্বিরের মায়ের ভয় আরও বাড়তে থাকল, ঘর-দুয়ার ততটাও ঠিক নেই, একটু বৃষ্টি হলেই ঘরের ভেতর গড়গড়িয়ে পানি পড়ে। কিন্তু আজ তো ঝড়ের আশঙ্কা।

অর্ধেক পথে গিয়ে সাব্বিরের মা তাকে বলল, চল বাবা আমরা বাড়ি চলে যাই। মুহূর্তেই সাব্বির কেঁদে উঠে বলল, তাহলে আমার বাজি? ওমনি কষিয়ে সাব্বিরের গালে একটা বসিয়ে দিল তার মা। যারা সংসার নিয়ে সংগ্রাম করে, টিকে থাকার সংগ্রাম, তাদের মন ভালো বেশিক্ষণ থাকে না। এইত হাসে, আবার হতাশায় ডুবে যায়, যেন নিজের জীবন-মনের সঙ্গে নিয়তির এক পৈশাচিক খেলা।

মায়ের চড় খেয়ে চুপচাপ সাব্বির মায়ের হাত ধরে বাড়ির পথ ধরল। বাড়ি এসে সাব্বিরের মা একটু একটু করে ঘর-দুয়ার গোছাচ্ছে। মনে অনেক ভয়, বৃষ্টি হলে না হয় ভিজে থাকবে, ঝড়-তুফান শুরু হলে কী করবে? একটা ছোট সন্তান নিয়ে কোথায় আশ্রয় নেবে? এসব ভাবতে ভাবতে সাব্বিরের মায়ের গলা ধরে আসে। সব রাতের মতোই অন্ধকার। কেরোসিনের বোতল নেড়ে দেখল এক ফোঁটা তেলও নেই, নেই একটা মোমবাতিও। সাব্বিরের মায়ের মাথায় হাত, রাতে ঝড়-তুফান শুরু হলে কী করবে? দৌড়ে রাস্তার মাথায় গিয়ে দেখল বিপদ-আপদে বাকি নেওয়া সেই কাশেম ও দোকান খোলেনি। আবহাওয়া ভালো না দেখে সবাই নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে ব্যস্ত। 

উপায় কী? প্রতিবেশি রানী দাদি। যার কাছে বিপদে-আপদে সাহায্য পাওয়া যায়। ততক্ষণে শেষ বিকেল, একটু একটু করে বাতাস বইতে শুরু করেছে। একটু কেরোসিন তো লাগবেই। কিন্তু এত কাজ ফেলে কীভাবে যাবে সাব্বিরের মা? উপায় না পেয়ে সাব্বিরের হাতে কেরোসিনের বোতল দিয়ে রানি দাদির বাড়ি পাঠাল। সাব্বিরকে পাঠানোর একটু পরেই শুরু হলো তুমুল ঝড়। সাব্বিরের মায়ের বুকে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল, ঘর সামলাবে নাকি সাব্বিরকে খুঁজবে! বাঘের গর্জনের মতো শব্দ নিয়ে বড় বইছে। আশপাশের সব উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সাব্বিরের মায়ের পাগলপ্রায় অবস্থা। রাত নামল, ঝড় তার যৌবনে পৌঁছেছে, কয়েক শ গাছ ভেঙে গেছে, উড়িয়ে নিয়ে গেছে সাব্বিরদের ঘরবাড়ি।

সাব্বিরের মা এরমধ্যে ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে সাব্বিরকে ডাকতে ডাকতে হয়রান, মাঝেমধ্যে গাছের ডালপালার ভেঙে যাওয়ার শব্দ সাব্বিরের মাকে আরও ভয় পাইয়ে দেয়। তার মনে হয় পুরো পৃথিবী উঠে-পড়ে লেগেছে তাদের নিঃশেষ করার জন্য। ছেলে কোথায়? আবার ভাবে স্বামীর কোনো অভিশাপ তাকে এমন পরিস্থিতিতে এনেছে কিনা, আবোল-তাবোল ভাবতে ভাবতে সাব্বিরের মা নীরব হয়ে যায়। 

হঠাৎ একটি বড় গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়ে সাব্বিরের মা। ঝড় থেমে গেছে, তখন মধ্যরাত, সাব্বিরের মায়ের আর ঘুম ভাঙেনি। যা ঘটার তা ঘটে গেছে ইতোমধ্যেই। সকালে ঘুম ভেঙে সাব্বিরের মা নিজেকে আবিষ্কার করল একটি গাছের নিচে। আকাশ পরিষ্কার, তবে আশপাশে লন্ডভন্ড অবস্থা। উপড়ানো গাছ আশপাশে সব পড়ে আছে। ঘুম ভেঙেই সাব্বিরের মা পাগল হয়ে ভাবতে লাগল, সাব্বিরকে ছাড়া পুরো রাত ঘুমালাম। দিগ্বিদিক সাব্বিরের খোঁজে ছুটতে লাগল তার মা।

খুঁজতে খুঁজতে দেখল বড় রাস্তার মোড়ে কিছু মানুষের জটলা। ভিড় ঠেলে দৌড়ে সাব্বিরের মা দেখতে গিয়ে লুুটিয়ে পড়ল মাটিতে। রাস্তার পাশেই একটি গরু চিৎ হয়ে পড়ে আছে মৃত। রাস্তার ওপরে উপড়ে যাওয়া গাছের নিচে চিরদিনের নিদ্রায় দূরন্ত সাব্বির, পাশেই হাত থেকে ফসকে পড়ে আছে কেরোসিনের বোতল। সাব্বিরের মায়ের চোখে পানি নেই, পাথর হৃদয়ে শুধু আদরের সন্তানের কপালে হাত বুলিয়ে দিল, আর উপলব্ধি করল এ জগতে আমার চেয়ে অপরাধী আর একাকী মানুষ আর কেউ নেই।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!