সম্প্রতি বাংলাদেশের আদালত প্রাঙ্গণে ডিম নিক্ষেপ করার ঘটনা একটি আলোচিত ও উদ্বেগজনক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। ঘটনাটির সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গায়েও ডিম লেগেছে, যা শুধু ব্যক্তির সম্মান নয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবমূর্তিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
প্রথমেই বলা দরকার, প্রতিবাদের অধিকার গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নাগরিকেরা যখন কোনো রাজনৈতিক নেতা বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করতে চায়, তখন তারা মিছিল, গণস্বাক্ষর, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে তা জানাতে পারে। কিন্তু একজন ব্যক্তির গায়ে ডিম ছুড়ে মারা কোনোভাবেই একটি গ্রহণযোগ্য প্রতিবাদ হতে পারে না।
ডিম না হয়ে যদি অন্য কিছু ছুড়ে মারা হতো?
এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় অত্যন্ত ভয়ংকর। ডিম একটি তুলনামূলকভাবে নিরীহ বস্তু হলেও সেটি যদি ইট, কাচের বোতল, বা দাহ্য পদার্থ হতো, তাহলে কোনো ব্যক্তি গুরুতরভাবে আহত হতে পারতেন। এমনকি জীবননাশের ঘটনাও ঘটতে পারত। এ ধরনের কাজ শুধু আইনগত অপরাধই নয়, বরং তা জননিরাপত্তার জন্যও বড় হুমকি।
কীভাবে একজন ব্যক্তি বা দল দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রতিষ্ঠানের আঙিনায় এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারে? এটি কেবল রাজনৈতিক উগ্রতা বা প্রতিশোধস্পৃহা নয়, বরং আইন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি চরম অবজ্ঞার প্রকাশ।
আদালত প্রাঙ্গণ একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও সুরক্ষিত এলাকা হিসেবে বিবেচিত। সেখানে বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী এবং বিচারকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেইসাথে, এখানে যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা বিচারকাজে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, যা পুরো বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করে। আদালত চত্বরে এমন কর্মকাণ্ড করার সাহস কীভাবে একজন পায়? এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় প্রশ্ন।
এই সাহসের উৎস হতে পারে বিচারব্যবস্থার দুর্বল প্রয়োগ, রাজনীতিকরণ, কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ভাইরাল’ হওয়ার মানসিকতা। অনেক সময় দেখা যায়, কিছু লোক তাদের কাজকে ‘প্রতীকী প্রতিবাদ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চায়, অথচ সেটি আসলে আইন ভঙ্গ এবং সমাজে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টির নামান্তর।
একজন জনপ্রতিনিধির গায়ে ডিম ছুড়ে মারা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে, কিন্তু এটি কখনোই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। কারণ, একটি সভ্য ও আইনের শাসনে বিশ্বাসী সমাজে এমন ঘটনা শুধু অবমাননাকরই নয়, বরং গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিকে দুর্বল করে তোলে। তাই এ ধরনের আচরণকে প্রশ্রয় না দিয়ে আইন ও নৈতিকতার পথে থেকে সমাধান খুঁজে নেওয়াই হচ্ছে সুস্থ সমাজ গঠনের প্রথম ধাপ।
‘ডিম নিক্ষেপ’ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
প্রতিবাদের অংশ হিসেবে কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক নেতার গায়ে ডিম ছুড়ে মারা এটি নতুন কোনো ঘটনা নয়, তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক ‘ট্রেন্ড’ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। এর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে কিছু বিষয় পরিষ্কার হয়:
ডিম ছুড়ে প্রতিবাদ জানানোর সংস্কৃতির জন্ম মূলত পশ্চিমা দেশগুলোতে, বিশেষ করে ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ায়।
১৯৭০ ও ৮০’র দশক থেকে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি জনগণের ক্ষোভ প্রকাশের একটি প্রতীকী কৌশল হিসেবে ডিম ছোড়ার ব্যবহার শুরু হয়।
অনেক সময় এটি ‘অ-হিংস্র প্রতিরোধ’ বা ‘symbolic protest’ হিসেবে দেখা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ান সিনেটর ফ্রেসার অ্যানিং মুসলিম বিদ্বেষী মন্তব্য করার পর এক কিশোর তার মাথায় ডিম ছুড়ে দেয়। সেই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় এবং অনেকেই তা বাহবা দেয়।
এ ধরনের ঘটনা যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হতে থাকে, তখন তা বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ‘অনুপ্রেরণা’ হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে এর আগমন ও প্রসার:
বাংলাদেশে এই ট্রেন্ড মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বহির্বিশ্বের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রভাব থেকেই এসেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকে এসব ঘটনা দেখে ভিন্নধর্মী প্রতিবাদ বলে মনে করছে।
তারা এটিকে একটি ‘স্টাইলিশ’ বা ভাইরালযোগ্য প্রতিবাদ হিসেবে নিচ্ছে, যা মিডিয়া কাভারেজ পায়, লোকজন আলোচনা করে এবং অপর পক্ষকে অপদস্থ করে।
এ ছাড়া, কিছু রাজনৈতিক কর্মীরা বা অসন্তুষ্ট জনগণ এই কাজটিকে দ্রুত আক্রোশ প্রকাশের মোক্ষম মাধ্যম হিসেবেও দেখছে।
মূলত আদালত কোনো সাধারণ জায়গা নয়। এটি ন্যায়বিচার, শৃঙ্খলা ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। সেখানে কোনোরকম অশালীন, সহিংস বা অপমানজনক আচরণ শুধু একজন ব্যক্তিকে নয় বরং গোটা বিচারব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। ডিম নিক্ষেপ কিংবা এই ধরনের ‘প্রতীকী প্রতিবাদ’ কখনোই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না বরং এটি অসহিষ্ণুতা, বিশৃঙ্খলা এবং আইনের প্রতি অবজ্ঞার প্রতিচ্ছবি। গণতন্ত্রে প্রতিবাদের অধিকার থাকলেও তা অবশ্যই শালীনতা, শৃঙ্খলা ও আইনের সীমার মধ্যে থেকে হতে হবে। আদালতের মতো মর্যাদাপূর্ণ স্থানে এমন অশালীন প্রতিবাদ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটা আমাদের নৈতিকতারও বড় ব্যর্থতা।
এখনই সময় সমাজ, রাষ্ট্র ও নাগরিক হিসেবে আমাদের এই বিকৃত ‘ভাইরাল’ সংস্কৃতির বিপরীতে দাঁড়ানোর এবং সুশৃঙ্খল প্রতিবাদ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেওয়ার।
আপনার মতামত লিখুন :