শুক্রবার, ০৯ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


শাহীনুর ইসলাম শানু 

প্রকাশিত: মে ৮, ২০২৫, ০৪:২৫ এএম

অবিবেচক কাণ্ড বেবিচকের!

শাহীনুর ইসলাম শানু 

প্রকাশিত: মে ৮, ২০২৫, ০৪:২৫ এএম

অবিবেচক কাণ্ড বেবিচকের!

পরিত্যক্ত উড়োজাহাজ। ছবি: সংগৃহীত

প্রায় এক যুগ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার পর ১২টি উড়োজাহাজ ‘স্ক্রাব হিসেবে’ বিক্রি করার উদ্যোগ নিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বিমানগুলো বিক্রি করতে ইতোমধ্যে আদালতের অনুমোদনও নিয়েছে সংস্থাটি। তবে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা মূল্যের বিমানগুলো রাজস্বসহ মাত্র ৩ কোটি ৭ লাখ ৭০ হাজার টাকায় কেনার প্রস্তাব দিয়েছে সেনা কল্যাণ সংস্থা (এসকেএস)।

নিয়মানুযায়ী বিমানগুলোর মূল্য নির্ধারণে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মূল্য যাচাই-বাছাই করার কথা। কিন্তু বাস্তবে সেটিও হয়নি। এতে সারচার্জ বাবদ প্রায় ৯১৫ কোটি টাকা আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ (বিডি) লিমিটেডের ১০টি রয়েছে। বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের জিএমজি এয়ারলাইন্সের ১টি এবং রিজেন্ট এয়ারওয়েজের একটি বিমান রয়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ও জিএমজি এয়ারলাইন্সের প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার বিনিয়োগকারীর অনুমোদন ছাড়াই বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই সঙ্গে বিমানগুলোর মালিকের কাছ থেকে ব্যাংকগুলোর পাওনা ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, জিএমজির কাছে পাওনা ৩৬০ কোটি, রিজেন্ট এয়ারওয়েজের কাছে ২০০ কোটি, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কাছে পাওনা ৩৫৫ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে তিন কোম্পানির ১২টি বিমানের সারচার্জ বাবদ বকেয়া ৯১৫ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ (বিডি) লিমিটেডের তারল্য সংকটে ২০১৬ সালে ১২টি বিমানের উড্ডয়ন স্থগিত করেন প্রতিষ্ঠাতা সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী। তার মধ্যে ১০টি বিমান ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পার্কিং করা হয়েছে। বাকি দুটির মধ্যে একটি কলকাতায় এবং একটি পাকিস্তানে রয়েছে। 
 
ইউনাইটেড এয়ারের ১২টি বিমানের মালিক ১ লাখ ৫০ হাজার বিনিয়োগকারী। তার মধ্যে ১০টি বিক্রি করার সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীদের আড়াল করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোকেও ঋণ পরিশোধ গ্যারান্টি না দিয়ে এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে বিএসইসিকে অন্ধকারে রেখে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেবিচক। একই সঙ্গে বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের জিএমজি এয়ারলাইন্সের বিরুদ্ধে এখনো মামলা আদালতে চলমান। প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির হাজার কোটি টাকা এখনো বিনিয়োগকারী ফেরত পায়নি। ৩০ মে, ২০১৬ পর্যন্ত, জিএমজি এয়ারলাইন্সের কাছে সোনালী ব্যাংকের ২.২৮ বিলিয়নের বেশি টাকা পাওনা রয়েছে। বিমান সংস্থাটির ৫০ শতাংশের বেক্সিমকো গ্রæপ বা মালিক সালমান এফ রহমানের ধানমন্ডির বাড়ি নিলামের চেষ্টা করেও পরে ব্যর্থ হয় ব্যাংক। ১৯৯৮ সালে জিএমজি আত্মপ্রকাশ করে। ২০০৪ সাল থেকে অভ্যন্তরীণ রুটের পাশাপাশি তারা আন্তর্জাতিক রুটেও ফ্লাইট শুরু করে ২০১২ সালের ২৮ মার্চ বন্ধের ঘোষণা দেয়। 

শাহজালালে পরিত্যক্ত ১২টি বিমান বিক্রির বিষয়ে রূপালী বাংলাদেশকে জানান বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মনজুর কবির ভুঁইয়া। তিনি বলেন,‘আমরা স্বচ্ছতার ভিত্তিতে আইনগত প্রক্রিয়ায় কাজ করছি। ইতোমধ্যে আদালতের অনুমোদন পেয়েছি। তবে ব্যাংক ঋণের চুক্তি যেহেতু আমাদের সঙ্গে হয়নি; তাই দায়বদ্ধ নই।’

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কাছে অনুমোদন সম্পর্কে চেয়ারম্যান বলেন, ‘আইনে যদি তাকে জানাতে হয়, অবশ্যই জানাব। আমরা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ এগিয়ে নিচ্ছি। আমাদের দক্ষ আইনজীবী কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন।’

তবে ইউনাইটেড এয়ারের বিমান বিক্রির বিষয়ে ১ লাখ ৫০ হাজার বিনিয়োগকারীর প্রবল আপত্তি রয়েছে। আড়াই হাজার কোটি টাকা মূল্যমানের হলেও বিমানবন্দর পরিষ্কার রাখতে স্কার্ব হিসেবে বিক্রির সিদ্ধান্তে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

তথ্যমতে, ইউনাইটেড এয়ার (বিডি), জিএমজি এয়ারলাইন্স এবং রিজেন্ট এয়ারওয়েজের কাছে ১২টি উড়োজাহাজের বিপরীতে বেবিচকের পাওনা ৯১৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে বিমানগুলোর মূল্য সর্বনিম্ন ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এসব বিমানের উড্ডয়ন না থাকলেও ব্যাংক ঋণ রয়েছে হাজার কোটি।
ইউনাইটেড এয়ারের ১০টি উড়োজাহাজ বিক্রির বিষয়ে অজানা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।

 তাদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে করপোরেট রিপোর্টিং বিভাগের পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘যার সম্পদ বিক্রি হচ্ছে, তাকে অবশ্যই মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করতে হবে। তবে বিএসইসি আইন অনুসারে বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আইন অনুসারে বেবিচক যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে, তবে আমরাও আইনের মাধ্যমে এ বিষয়ে সঠিক সুরাহার সিদ্ধান্ত নেব। সেখানে অবশ্যই বিনিয়োগকারীর স্বার্থ আমরা দেখব।’

বিস্ময়কর বিষয় হলো ইউনাইটেড এয়ারের এখন কোনো পরিচালনা পর্ষদ নেই। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানকে বিভিন্ন কারণে সরিয়ে দিয়ে নতুন পর্যদ গঠন করে সাবেক শিবলী রূবাইয়াত-উল-ইসলাম কমিশন। ব্যর্থতায় নতুন পর্ষদ পদত্যাগ করেছে। প্রতিষ্ঠানের দাপ্তরিক কার্যক্রম চালাতে এখন নেই অফিস, কর্মকর্তা বা কর্মচারী। বিমানের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শিবলি কমিশনের চাপে প্রায় তিন বছর আগে দেশ ছেড়ে লন্ডনে অবস্থান নিয়েছেন। কোম্পানির পক্ষ কে এবং কীভাবে মূল্য সংবেদনশীল তা প্রকাশ করা হবে এটা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।

জানতে চাইলে হোয়াটসঅ্যাপে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ (বিডি) লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘এটা অজ্ঞতার পরিচয়। বিমান সিচেক করলেই ব্যবহার উপযোগী হয়। খুব অল্প ব্যয়ে বিমানগুলো ব্যবহার উড্ডয়ন উপযোগী করা সম্ভব। তাছাড়া প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার দেশের সম্পদ আন্তর্জাতিক কোনো পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মতামত ছাড়াই বিক্রি করাও দুঃখজনক।’

‘শিবলী কমিশনকে একশ কোটি টাকা চাঁদা না দেওয়ায় বিমান উড্ডয়ন করতে না পারার’ ক্ষোভ প্রকাশ করেন ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী। তবে সরকারের কাছে আর একবার পরিচালনার অনুমতি চেয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০১১ সালে প্রথম লন্ডন টু সিলেট সরাসরি বিমান ফ্লাইড চালু করে ইউনাইটেড এয়ার। সে সময়ে নিজের টাকায় কেনা এয়ারলাইন্সে চড়ে গর্বের সঙ্গে দেশে আসতেন বিনিয়োগকারী ও প্রবাসী বাঙালিরা। প্রবাসীদের টাকায় কেনা ১০টি উড়োজাহাজ বহরে যুক্ত হলেও ২০১৬ সাল থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। বছরে ১২ লাখ আরোহীকে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। যার বেশির ভাগ মুনাফা এখন লুফে নিচ্ছে বিদেশি এয়ার লাইন্সগুলো। কাজেই বিক্রির বিষয়ে সরকারকে আরও ভাবতে হবে।’

‘বিমানগুলো ‘সিচেক’ করা হলে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী হবে। অন্যসব যন্ত্রাংশের মতোই নির্দিষ্ট যত্রাংশ বদল করে বিমান ব্যবহার উপযোগী করা যায়। অন্য দেশগুলোতেও সিচেক করেই ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হয়’ বলেন বিমানের যন্ত্রপ্রকৌশলী মো. সেলিম।

তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা ব্যয় করতে চাই না; শুধু মুনাফা চাই। এগুলোকে ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব। দেশের স্বার্থে বিমানগুলো বিক্রি না করাই উত্তম।’

ইউনাইটেড এয়ারের শেয়ার ক্রেতা আনোয়ার হোসেন নামের এক বিনিয়োগকারী ক্ষুব্ধ হয়ে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিমান বিক্রি করতে চাইলে বিএসইসিকে জবাব দিতে হবে। আমার অনুমতি ছাড়া আমার কোম্পানির বিমান কীভাবে বিক্রি হয়? ব্যাংকগুলোর ঋণের কি হবে সব সুরাহা করেই বেবিচক বিক্রি করতে পারবে। না হলে দেশের সব বিনিয়োগকারী মিলে আন্দোলন করব, মানববন্ধনে যাব। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. ইউনূসকে আমরা আগেই চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। আমি আমার বিনিয়োগের গ্যারান্টি চাই’ বলেন আনোয়ার হোসেন।

সেনা কল্যাণ সংস্থা গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ১২টি অকেজো উড়োজাহাজ এবং আনুষঙ্গিক ইঞ্জিন ও সরঞ্জাম স্ক্রাব হিসেবে কিনতে ৩ কোটি টাকার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে বলা হয়, ‘সেনা কল্যাণ সংস্থার অধীন ট্রেডিং ডিভিশন কর্তৃক সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অকেজো অনুপযোগী বিভিন্ন ধরনের স্ক্র্যাপ ও অন্যান্য মালামাল ক্রয় করে আসছে। বেবিচকের আওতাধীন ১২টি অকেজো উড়োজাহাজ এবং আনুষঙ্গিক ইঞ্জিন ও সরঞ্জাম আমাদের প্রতিনিধি পরিদর্শন করেছে। এগুলো আয়কর ও ভ্যাট ছাড়া ৩ কোটি ৭ লাখ ৭০ হাজার টাকায় কিনতে ইচ্ছুক। সেই সঙ্গে এসব মালামাল সেনা কল্যাণ সংস্থাকে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হয়েছে চিঠিতে।

জানতে চাইলে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী ওয়াহিদুল আলম সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা ৩০০ কোটি টাকা সারচার্জ মওকুফের জন্য আবেদন করেছিলাম। আর মূল বকেয়া ৫৫ কোটি টাকা এয়ারলাইন্স চালু হওয়ার পর ক্রমান্বয়ে দেব বলেছিলাম। এ প্রস্তাবে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্মতি দেয়নি। ফলে এয়ারলাইন্স পরিচালনায় এওসি নবায়ন করতে পারিনি। এখন পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে।’

কাজী ওয়াহিদুল আলম আরও বলেন, ‘বেবিচক এগুলো বিক্রি করলে একভাগ দামও পাবে না। পুরোনো হলেও এগুলোর রিসেল দাম আছে। বেবিচক সেভাবে করতে পারবে না। এয়ারলাইনগুলোর ব্যাংকে লোন থাকায়, ব্যাংক এগুলো বিক্রি করতে অনুমতি দেবে না। এখানে আইনগত ঝামেলা রয়েছে।’

উল্লেখ্য, দীর্ঘ সময় ধরে পার্কিংয়ে পড়ে আছে ১২টি উড়োজাহাজ। এগুলোর পার্কিং ও সারচার্জ বাবদ বকেয়া ৯১৫ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এগুলো সরিয়ে নিতে মালিকপক্ষকে বারবার চিঠি দেওয়া হলেও পার্কিং ও সারচার্জ জমা না দেওয়ায় বিক্রি করতে সিদ্ধান্ত নেয় বেবিচক।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!