ঢাকা রবিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৫

ভূমিকম্প কীভাবে শনাক্ত ও পরিমাপ করা হয়?

ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৩, ২০২৫, ০৬:২১ পিএম
ভূমিকম্প সনাক্তকরণ। ছবি- সংগৃহীত

পৃথিবীর ভেতরে জমে থাকা চাপ হঠাৎ মুক্ত হয়ে গেলে বা শিলার এক পাশে আকস্মিক সরণের কারণে ভূমিকম্প ঘটে। শিলার এই সরে যাওয়ায় ভূকম্পীয় তরঙ্গ তৈরি হয়, যা পানিতে পাথর ফেললে ঢেউ ছড়ানোর মতো পৃথিবীর ভেতর দিয়ে ছড়ায়। আমরা এগুলোকে ভূমিকম্প হিসেবে অনুভব করি।

ভূমিকম্প সনাক্তকরণ

ভূমিকম্প শনাক্ত করতে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন সিসমোমিটার। এটি এমন একটি যন্ত্র যা ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বা অন্য কোনো কারণে ভূত্বকের কম্পন পরিমাপ করে। যন্ত্রটি জড়তার নীতির ওপর কাজ করে। ভূমি কম্পিত হলেও এর ঝুলন্ত ভর স্থির থাকে, আর বাইরের কাঠামো নড়ে। এই আপেক্ষিক নড়াচড়া বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত হয়ে গ্রাফ আকারে রেকর্ড হয়, যাকে সিসমোগ্রাম বলা হয়।

আধুনিক সিসমোমিটার এত সংবেদনশীল যে, দূরের সমুদ্রের ঢেউ, বড় ট্রাকের চলাচল বা বাতাসের দোলনও ধরতে পারে। তবে ভূকম্পবিদরা এই অপ্রয়োজনীয় শব্দ ফিল্টার করে মূল ভূমিকম্পের সংকেত আলাদা করেন।

ত্রিমাত্রিক কম্পন রেকর্ডিং

সিসমোমিটার সাধারণত তিনটি দিকের কম্পন রেকর্ড করে- উপর–নিচ (Z), পূর্ব–পশ্চিম (E), উত্তর–দক্ষিণ (N)। তিনটি উপাদান মিলিয়ে ভূমিকম্পের পূর্ণ গতিবিধি জানা যায় এবং বড় ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ফাটলের ধরনও নির্ধারণ করা যায়।

ভূকম্পীয় তরঙ্গ

ভূমিকম্পের সময় তিন ধরনের তরঙ্গ তৈরি হয়:

পি-তরঙ্গ (প্রাথমিক তরঙ্গ): সবচেয়ে দ্রুতগতির। এটি সংকোচন–প্রসারণের মতো কম্পন ছড়ায়। অনেক সময় প্রাণীরা এগুলো আগেভাগেই অনুভব করে।

এস-তরঙ্গ (দ্বিতীয় বা শিয়ার তরঙ্গ): ধীরে চলে এবং ভূমিকে লম্বভাবে দুলায়। ভবনের ক্ষতির জন্য এটি সবচেয়ে বিপজ্জনক। তরল বা গলিত পদার্থে ছড়াতে পারে না।

পৃষ্ঠ তরঙ্গ: পি ও এস তরঙ্গ পৃষ্ঠে পৌঁছে একত্রিত হয়। সবচেয়ে বিধ্বংসী। এখানে দুই প্রকার আছে— ১) রেলে তরঙ্গ: উপরে–নিচে এবং সামনের দিকে ঘূর্ণায়মান কম্পন তৈরি করে।২) প্রেম তরঙ্গ: মাটিকে পাশে ঠেলে দেয়, সাধারণত সবচেয়ে তীব্র দুলুনি তৈরি করে।

ভূমিকম্পের অবস্থান নির্ণয়

ভূমিকম্প বিভিন্ন ধরণের তরঙ্গ তৈরি করে- তৈরি তরঙ্গগুলো পৃথিবীর মধ্যেই দ্রুত গতিতে ভ্রমণ করে। পি–এস সময় ব্যবধান ভূমিকম্প কোথায় ঘটেছে জানতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো— সিসমোমিটারে পি-তরঙ্গ ও এস-তরঙ্গের আগমনের ব্যবধান। কারণ— পি-তরঙ্গ, এস-তরঙ্গের গতি জানে- তাই তাদের আগমনের ফাঁক যত বেশি, ভূমিকম্প তত দূরে।

একটি সিসমোমিটার শুধু দূরত্ব জানায়, দিক নয়। তাই তিনটি পৃথক স্থানে থাকা সিসমোমিটারের তথ্য দিয়ে তিনটি বৃত্ত আঁকা হয়। তিন বৃত্ত যেখানে মিলিত হয়, সেটিই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল। বিশ্বজুড়ে ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলো এই পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক মানচিত্র তৈরি করে।

ভূমিকম্পের পরিমাপ

তীব্রতা: ভূমিকম্প কতটা শক্তভাবে অনুভূত হয়েছে তা বোঝার জন্য মানুষের অভিজ্ঞতা, ভবনের ক্ষতি ও অবকাঠামোগত প্রভাবের ভিত্তিতে তীব্রতা নির্ধারণ করা হয়। ইউরোপীয় ম্যাক্রোসিজমিক স্কেল (ইএমএস) অনুযায়ী এক থেকে বারো ধাপে ভাগ করা হয়। কেন্দ্রস্থলের কাছে তীব্রতা বেশি, দূরে কম।

মাত্রা: ভূমিকম্প কত শক্তি নির্গত করেছে তা বোঝায়। সিসমোমিটার রেকর্ডের প্রশস্ততা থেকে গণনা করা হয়। মাত্রার স্কেল লঘুগাণিতিক- মাত্রা ১ বৃদ্ধি মানে প্রশস্ততা ১০ গুণ এবং শক্তি প্রায় ৩২ গুণ বৃদ্ধি। বড় ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে মুহূর্ত মাত্রা (এমডাব্লইউ) সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। এটি ফাটলের আকার, সরে যাওয়া দূরত্ব এবং শিলার শক্তি বিবেচনা করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৪ সালের সুমাত্রার ভূমিকম্প প্রথমে ৯.০ ধরা হলেও পরে বিশ্লেষণে ৯.৩ ধরা হয়।