মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনা বা রিভিউ চেয়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামের করা আবেদনের শুনানি শুরু হয়েছে। আংশিক শুনানির পর বুধবার পর্যন্ত শুনানি মুলতুবি করেছে আপিল বিভাগ। মঙ্গলবার সকাল সোয়া দশটায় প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদসহ পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চে এ আবেদনটির শুনানি শুরু হয়।
এ দিন শুনানির সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।
পরে সাংবাদিকদের মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, "কোর্টের উপর চাপ প্রয়োগের কোন প্রশ্নই ওঠে না। আমরা আইনের প্রতি, আদালতের প্রতি সবসময় শ্রদ্ধাশীল। আমরা ন্যায়বিচার প্রত্যাশী। এটা সাব-জুডিশ ম্যাটার। আমরা ন্যায়বিচারের জন্যই অপেক্ষা করতেছি।" শুনানি পর্যবেক্ষণ করার জন্য তিনি আদালতে উপস্থিত ছিলেন বলে জানান জামায়াতের এই নেতা।
"আগামীকাল শুনানি শেষে নিশ্চয়ই আদালত কোন আদেশ দেবেন। কোর্ট সিদ্ধান্ত নেবে, আদালতের জুলুমের বিরুদ্ধে ইনশাআল্লাহ ন্যায়বিচার আমরা পাবো" বলেন মি. পরওয়ার।
পাঁচই অগাস্ট ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা এ টি এম আজহারুল ইসলামের মুক্তির দাবিতে গত কয়েকদিন ধরেই বিক্ষোভ সমাবেশ করছে।
আজহারুল ইসলামকে মুক্তি না দিলে স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার হওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান। আজ মঙ্গলবার আদালতে অবস্থান কর্মসূচিও ঘোষণা করেন তিনি।
এরই মধ্যে গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার রিভিউ আবেদনটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আসে। পরে সেটি আজ মঙ্গলবার শুনানির দিন ঠিক করা হয়। এরই প্রেক্ষাপটে সোমবার রাতেই স্বেচ্ছা গ্রেপ্তারের কর্মসূচি স্থগিত করেন জামায়াতের আমির মি. রহমান।
আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ ?
জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামকে মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে করা আবেদনের শুনানিতে আপিল বিভাগ ও ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তার আইনজীবীরা। সাতটি যুক্তিতে আগের রায় পুনর্বিবেচনা চাওয়া হয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন।
আজহারুল ইসলামের আইনজীবীরা পূর্বে আপিল বিভাগের দেয়া রায় প্রশ্নবিদ্ধ বলে উল্লেখ করেন। তাদের অভিযোগ, প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে আগে রায় দিয়েছিল আপিল বিভাগ।
কিন্তু বাংলাদেশের আইনানুযায়ীই আন্তর্জাতিক আইন মেনে বিচার ও রায় দিতে হবে বলে জানান আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক।
আজহারুল ইসলামের আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক বলেন, "আন্তর্জাতিক আইন না মেনে এর আগে আপিল বিভাগ, ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের আইনেই আছে ইন্টারন্যাশনাল ল মেনে রায় দিতে হবে। এটা হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল অফেন্সেস"।
রিভিউ আবেদনের শুনানিতে এই যুক্তিই প্রধান গ্রাউন্ড বলে জানান সিদ্দিক।
আন্তর্জাতিক আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলতে `সিস্টেমেটিক` এবং ` ওয়াইড স্প্রেড` (ব্যাপক হারে সংগঠিত) এই দু`টি উপাদান থাকতে হবে বলে উল্লেখ রয়েছে।
আইনানুযায়ী সিস্টেমেটিক বলতে অর্গানাইজড বা সংগঠিতভাবে কোন কিছু করা বোঝায়। আর ওয়াইড স্প্রেড বলতে ব্যাপক হারে ঘটনা ঘটা বা আক্রমণকে বোঝায়।
সিদ্দিক জানান, "যদি কোন মামলার অভিযোগে এ দুইটি উপাদান না থাকে তবে সেটি মানবতাবিরোধী অপরাধ হবে না।"
২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন থেকে এই দুইটি উপাদান রহিত করা হয়। ওই বছরই আরেক জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়।
সিদ্দিক বলেন, "যদি আন্তর্জাতিক আইন মেনে বিচারটা হতো, সিস্টেমেটিক ও ওয়াইড স্প্রেড এই এলিমেন্টস আনা হতো তাহলে ২০১৩ সালে আপিল বিভাগে আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড হয় না। আমাদের দেশের আইন থেকে এই উপাদানগুলো বাদ দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার জন্য। এ কারণেই তারা ল অ্যামেন্ড করেছিলেন"।
১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের যে বিচার হয়েছে, তাতে সে সময় প্রসিকিউশন আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি বলে দাবি করেন মি. সিদ্দিক।
তিনি দাবি করেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী বিচার না হলে সেটা দেশীয় আইনের হত্যাকাণ্ডের সমান হয়ে যায়।
মি. সিদ্দিকের দাবি যেহেতু আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী এসব মামলায় প্রসিকিউশন অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি সে কারণেই ২০১৩ সালে আপিল বিভাগ আইন পরিবর্তন করে ওই `সিস্টেমেটিক ও ওয়াইড স্প্রেড` অংশটুকু বাদ করে দেয়।
"অথচ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছিল এটি দেশীয় আদালত। আন্তর্জাতিক আইন এখানে প্রযোজ্য না। অথচ সিয়েরালিওন, রুয়ান্ডা, টোকিও, যুগোস্লাভিয়াতে এই প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিচার হয়েছে" বলেন মি. মনির।
মানবতাবিরোধী অপরাধে যাদের বিচার হয়েছে, সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে তাদের বিচার করা সম্ভব হতো না বলেই আন্তর্জাতিক আইনের বদলে দেশীয় আইনে বিচার করা হয়েছে বলে দাবি করেন মি. মনির।
ফলে এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার হওয়া ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া সব আসামিদের বিচার প্রশ্নবিদ্ধ এবং অবিচার হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
"শুধু আজহার নয়, মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাশেম আলীসহ সকলের ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক আইনের প্রথাগত বিধান প্রযোজ্য নয় মর্মে পূর্বে রায় দিয়েছে। অতীতের সবগুলো রায়ে এই পয়েন্টে রিভিউ হলে তাহলে আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ না করার কারণে অবিচার হয়েছে এটা আবার প্রমাণ হবে" বলেন মি. মনির।
তিনি দাবি করেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দায়ে আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী প্রসিকিউশন এই অভিযোগও প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলো বলে দাবি এহসান এ সিদ্দিকের।
তিনি জানান, এই অভিযোগ প্রমাণ করতে যে মানদণ্ড রয়েছে " এটাকে অ্যাফেক্টিভ কন্ট্রোল বলে। এখানে দেখাতে হবে অপরাধীর সাথে সুপিরিয়র সাব-অর্ডিনেট রিলেশনশিপ আছে।"
"এবং ক্ষমতা ছিল অধীনস্তদের কাজ থেকে বিরত করা বা ওই কাজের পর তাদের শাস্তি দেয়া। কিন্তু প্রসিকিউশন কোথাও দেখায়নি আসামিরা প্রতিরোধ বা শাস্তি দিতে পারতো। এটা না দেখালে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি অপরাধ হয়নি" বলেন মি. সিদ্দিক।
আপিল বিভাগ এ মামলায় `লিভ` মঞ্জুর করলে আবেদনটি আপিল হিসেবে শুনানি হবে বলে জানিয়েছেন এই আইনজীবী।
২০১৪ সালের ৩০শে ডিসেম্বর এ টি এম আজহারুল ইসলামকে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করলে ২০১৯ সালের ৩১ শে অক্টোবর ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ।
পরে ২০২০ সালের ১৯ শে জুলাই খালাস চেয়ে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিভিউ আবেদন করেন মি. ইসলাম। ওই আবেদনের শুনানিই মঙ্গলবার শুরু হলো।

 
                             
                                    
 সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন