নরসিংদীর শিবপুরের উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মো. হারুনুর রশিদ খান হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মহসীন মিয়াকে (৪৬) ইন্টারপোলের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে বলে জানিয়েছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
গ্রেপ্তার মহসীন মিয়াকে ২০ জুলাই দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পিবিআই নরসিংদী জেলায় হাজির করা হয়।
বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) দুপুরে নরসিংদীতে পিবিআইয়ের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, ভিকটিম বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মো. হারুনুর রশিদ খান নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি দীর্ঘ ২৫ বছর শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।
ভিকটিম প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়ার পর তার বাসভবনে প্রায় সময়ই এলাকার লোকজনদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতেন। আসামিরা ভিকটিমকে হত্যার পরিকল্পণা করে এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ১নং আসামি আরিফ সরকার ২০১৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৮টার পর একটি বিদেশি নম্বর দিয়ে ভিকটিমকে ফোন করে বলে, ‘আমি বিদেশে চলে এসেছি এবং আগামীকাল মহসীন মিয়া আপনার নিকট মসজিদের অনুদানের জন্য কিছু টাকা নিয়ে আসবে।’
ভিকটিম জানায় সকালে আসতে বলো। ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৬টার পর এজাহারনামীয় ২নং আসামি মহসীন মিয়া একটি মোটরসাইকেলযোগে দুটি পিণ্ডলসহ দুইজন শুটারম্যান নিয়ে ভিকটিমের বাসভবনের নিচে গিয়ে তাকে ফোন করে বলে, ‘আরিফ আমাকে মসজিদের অনুদানের জন্য কিছু টাকা দিয়ে পাঠিয়েছে এবং আমি আপনার বাসার নিচে আছি।’
ভিকটিম মহসীন মিয়াকে তার বাসভবনের ৩য় তলার ড্রয়িং রুমে এসে বসতে বলেন এবং ড্রয়িং রুমের দরজা খুলে দেন। মহসীন মিয়া দুইজন শুটারম্যান ও দুটি পিস্তল নিয়ে ভিকটিমের বাসভবনে প্রবেশ করে। ভিকটিম ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে এবং বলেন, ‘তোমরা বস, আমি তোমাদের জন্য একটু ফল কেটে নিয়ে আসি।’ সোফা থেকে উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই দুইজন শুটারম্যান ভিকটিমের কোমড়ে দুই রাউন্ড গুলি করে তারা ৩য় তলা থেকে দৌঁড়ে নেমে মোটরসাইকেল দিয়ে পালিয়ে যায়। অপর আসামি হুমায়ুন একটি প্রাইভেটকার নিয়ে অবস্থান করে।
আসামিরা ওই প্রাইভেটকার দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে দেশের বাহিরে চলে যায়। ভিকটিমকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে তার শরীর হতে দুটি বুলেট বের করা হয়। তাকে দেশে ও বিদেশে চিকিৎসা করানো হলেও শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় একই বছরের ৩১ মে মৃত্যুবরণ করেন।
এই ঘটনায় ২০২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ভিকটিমের ছেলে বাদী হয়ে শিবপুর মডেল থানার মামলা নং-১৭, ধারা-৩২৬/৩০৭/১১৪/১০৯/ ৩৪/সংযুক্ত ৩০২ পেনাল কোড দায়ের করেন।
শিবপুর থানা পুলিশ আসামিদের বহনকারী ড্রাইভার নূর মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করে এবং তাকে বিজ্ঞ আদালতে ফৌ. কা. বি. ১৬৪ ধারা মোতাবেক দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। রে ২০২৩ সালের ৭ মার্চ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা শাখা হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রসহ ফরহাদ হোসেন (৩৪) ও আরিফুল ইসলাম (২৮) নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করেন।
শিবপুর থানা পুলিশ আসামিদেরকে নরসিংদীর শিবপুরের উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ নরসিংদী কোর্টে উপস্থাপন করা হয়। একই বছরের ১৮ ও ২৬ মার্চ শিবপুর থানা পুলিশ আসামিদের বিরুদ্ধে রিমান্ডের আবেদন করলে বিজ্ঞ আদালত রিমান্ডের আবেদন নামঞ্জুর করেন। পরবর্তীতে ভিকটিমের ছেলে বাদী আমানুর রশিদ খানের আবেদনের প্রেক্ষিতে পুলিশ হেডকোয়াটার্সের নির্দেশে ২৩ জুন পিবিআই নরসিংদী জেলা মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে এবং এসআই (নিরস্ত্র) মন্তোষ চন্দ্র দাস মামলার তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেন।
পিবিআই প্রধান অ্যাডিশনাল আজিপি জনাব মো. মোস্তফা কামাল এর তত্ত্বাবধান ও দিক নির্দেশনায় এবং পিবিআই নরসিংদী জেলার সাবেক ইউনিট ইনচার্জ পুলিশ সুপার জনাব এনায়েত হোসেন মান্নান এর সার্বিক সহযোগিতায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই (নি.) মন্তোষ চন্দ্র দাস আসামী জহিরুল ইসলাম শরীফ মোল্লাকে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সময় গ্রেপ্তার করে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করে। আসামি জহিরুল বিজ্ঞ আদালতে ফৌ. কা. বি. ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে।
পিবিআই এর জিজ্ঞাসাবাদে আসামি জহিরুল জানান, আসামিদের সঙ্গে তার হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়েছে। আসামি আরিফ সরকার এর পরিকল্পনায় আসামি মহসীন মিয়া, আসামি ইরান মোল্লা ও আসামি মোবারক ভিকটিমকে তার বাসভবনে গুলি করে এবং আসামি হুমায়ুন একটি প্রাইভেটকার ভাড়া করে তাদেরকে আখাউড়া স্থলবন্দরে পৌছে দেয় এবং আসামিরা বিদেশে অবস্থান করতেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ওই ঘটনার পর পিবিআই পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে ইন্টারপোলের সহায়তা চায়। ইন্টারপোল চিঠি দিয়ে নিশ্চিত করে, আরিফ, মহসিন ও হুমায়ুন আরব আমিরাতে অবস্থান করছেন। ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে শুটার মোবারক দেশে ফিরলে গত ৯ মার্চ ঢাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এজাহারভুক্ত আসামি আরিফ ও মহসিনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে রেড নোটিশ জারির পর ২১ মে দুবাই পুলিশ মহসিনকে গ্রেপ্তার করে। গত ১৫ জুলাই বাংলাদেশ পুলিশের একটি দল দুবাই গিয়ে তাকে নিয়ে ২০ জুলাই দেশে ফেরেন।
এ বিষয়ে পিবিআই নরসিংদী জেলার ইউনিট ইনচার্জ পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি) এস.এম. মোস্তাইন হোসেন বিপিএম (বার) বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর মহসীন মিয়ার বর্তমান অবস্থান নিশ্চিত হই এবং তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির ব্যবস্থা করি। দুবাই পুলিশ রেড নোটিশের কপির ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করে আমাদের জানালে পুলিশের একটি টিম দুবাই গিয়ে মহসীন মিয়াকে দেশে ফেরতে আনতে সক্ষম হয়। তাকে ২১ জুলাই বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করলে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি প্রদান করে। পিবিআই ন্যায় বিচার প্রতিষ্টায় সর্বদা স্বচেষ্ট।