আমি এখনই বিদেশে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ বলতে চাই না। কারণ এখনো অনেকটাই ‘বার্ড ইন দ্য বুশ’—মানে, খাঁচার বাইরে পাখি। যেটা খাঁচায় আছে, সেটা নিয়ে কিছু করা সম্ভব। আমাদের প্রথম লক্ষ্য—অ্যাসেট ফ্রিজ করে আটকে ফেলা, এরপর আইনগত প্রক্রিয়ায় টাকা ফেরত আনা। এই পুরো প্রক্রিয়ায় ৪–৫ বছর সময় লাগবে, এটাই আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
দেশের একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি।
এস আলমের প্রক্সি বা বেনামে নেওয়া শেয়ার ও ঋণের প্রকৃত মালিকানা আদালতে কীভাবে প্রমাণ করবেন?এ প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, কাগজে হয়তো অনেকের নাম নেই। কিন্তু, ব্যাংকগুলোয় ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশন ইতিমধ্যেই করা হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, এসব অর্থ বিভিন্নভাবে ঘুরেফিরে আলটিমেট বেনিফিশিয়ারি সেই এক পরিবারের কাছে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, কিছুক্ষেত্রে আমরা ‘রাজসাক্ষী’ ধরনের সাক্ষ্যও পাবো – এমন ব্যক্তিদের যারা এসব লেনদেনে জড়িত ছিলেন এবং সাক্ষ্য দেবেন যে তারা এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছেন বা অংশীদার ছিলেন। সাধারণত সাজা ও জরিমানা কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে এধরনের সাক্ষীদের পাওয়া যায়– আমাদের বিশ্বাস এভাবে এটি প্রমাণ করা সম্ভব হবে।
অর্থ পাচার সংক্রান্ত যেসব মামলা আছে, বিশেষ করে দুদকের মামলা হলে সেটি কিভাবে দেখা হবে? এ প্রশ্নের উত্তরে গভর্নর বলেন, যদি দুদক মামলা করে, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ কোনো স্কোপ (সুযোগ) থাকে না। সিভিল কেস হবে না, তখন সেটা হয়ে যাবে ক্রিমিনাল কেস। তাই আমাদের শুরুতেই ডিসিশন নিতে হবে—কোন কেস কিভাবে হ্যান্ডেল করা হবে। এটাকে আমরা বলি ‘ডিকনফ্লিক্টিং।’
তিনি বলেন, এজন্য আমরা একটি প্যানেল নিয়োগ করতে যাচ্ছি। এই প্যানেলের দায়িত্ব হবে মামলাগুলো পর্যালোচনা করে বলা—কোনটি সিভিল, কোনটি ক্রিমিনাল। তারপর আমরা সেই অনুযায়ী আগাম ব্যবস্থা নেব। এই প্রক্রিয়াটি এখন চলমান।
ডলারের দাম প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, আমি প্রথম দিন থেকেই এক কথা বলে আসছি—আমাদের লক্ষ্য এক্সচেঞ্জ রেটের স্ট্যাবিলিটি, কিন্তু সেটা ফিক্সড নয়, বরং বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমি শুরু থেকে বলতাম, মূল্যস্ফীতি যদি কমাতে হয়, বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতেই হবে। এটা ছিল আমার কাছে প্রথম অর্ডার অফ বিজনেস।
তিনি বলেন, আমি আসার পর রিজার্ভ থেকে এক ডলার বিক্রি করিনি। এখন পর্যন্ত বিদেশি যেসব ওভারডিউ পেমেন্ট করেছে তার পুরোটা মার্কেট থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করে দিয়েছি। আমরা কয়েক মাস আগে ফ্লেক্সিবল এক্সচেঞ্জ রেটে গিয়েছি। অনেকে তখন বলেছিল মুদ্রার বিনিময় হার ১৫০ -১৭০ টাকা হয়ে যাবে—পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় যেটা হয়েছিল।
আমদানি কমে যাওয়া নিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমদানি করা ব্যবসায়ীদের দায়িত্ব। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ নয় জোর করে আমদানি করানো। বর্তমানে কোনো আমদানির বিধিনিষেধ নেই— মার্জিন নেই, শর্ত নেই। কেউ চাইলে বিনিয়োগ করুক—সেটা তো বিনিয়োগকারীর সিদ্ধান্ত। সরকারের কাজ হবে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা।
তিনি বলেন, অনেকে বলছেন, আমদানি কমে গেছে। কিন্তু বাজারে কি কোনো পণ্যের ঘাটতি আছে? কেউ কি বলতে পারবে—কোনো জিনিস পাওয়া যাচ্ছে না? বাজারে সবই আছে। তাহলে আমি কেন জোর করে আমদানি করাব? বাজারকে তার নিজের গতিতে চলতে দিন।
নতুন মুদ্রানীতি নিয়ে গভর্নর বলেন, মুদ্রানীতি নিয়ে আমার অবস্থান খুব স্পষ্ট। পলিসি রেট (নীতি সুদহার) এবং ইনফ্লেশনের মধ্যে অন্তত ৩ শতাংশ পার্থক্য রাখতে হবে। অর্থাৎ পলিসি রেট মূল্যস্ফীতির চেয়ে ৩ শতাংশ বেশি থাকবে। যদি আমরা ইনফ্লেশন ৩ শতাংশ বা ৪ শতাংশে নামাতে পারি, তখন পলিসি রেটও ৬-৭ শতাংশে নামবে। ফলে ইন্টারেস্ট রেট ৮-৯ শতাংশ হবে। সেটাই আমাদের টার্গেট। তবে এজন্য কিছু প্রি-কন্ডিশন পূরণ করতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :