সাড়ে ১৫ বছর দোর্দণ্ড প্রতাপের সাথে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম ক্ষমতাচ্যুত কোনো সরকার প্রধান দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলো। এরই মধ্য দিয়ে পনের বছরের অপশাসনের পর ৫ আগস্ট ২০২৪ নতুন সূর্য উদিত হয়।
বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করতে পারছিল না যে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। তবে এটাই সত্যি যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ডাকে ‘লং মার্চ টু’ ঢাকা কর্মসূচির পর জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এই ঘটনা ঘটার আগে ৪ আগস্ট রোববার রাত এবং সোমবার সকাল থেকে নানা নাটকীয়তা হয়েছে।
৪ আগস্ট বিকেলে আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা ও উপদেষ্টা শেখ হাসিনাকে জানান যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বিক্ষোভকারীদের প্রতিরোধের মুখে বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতারা পিছু হটছে। কিন্তু শেখ হাসিনা পরিস্থিতি মানতে নারাজ ছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন, শক্তি প্রয়োগ করেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। এ পর্যায়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে জানিয়েছিলেন যে এটি আর সামাল দেওয়া যাবে না।
গণভবনে কী ঘটেছিল
গণভবনে ৪ আগস্টের রাতটি ছিল খুবই উত্তেজনাপূর্ণ ও ভয়ংকর। ওই রাতে নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কয়েক দফা বৈঠক হয়। তিনি বৈঠক করেন মন্ত্রী, দলের শীর্ষ নেতা ও বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তির সঙ্গে। বৈঠকে রাগারাগি ও উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়।
রাত ১২টা থেকে সোয়া ১২টার দিকে তিন বাহিনীপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকী। সে বৈঠকে পদত্যাগের বিষয়টি ওঠানো হলে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে বলতে থাকেন, যা হওয়ার হবে, তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন না। শেখ হাসিনা সেনাপ্রধানকে মেরুদণ্ড শক্ত করে কঠোর হয়ে বিক্ষোভ দমনের জন্য বারবার বলতে থাকেন। জেনারেল তারেক সিদ্দিকী শেখ হাসিনাকে সমর্থন জানিয়ে বলতে থাকেন, সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে কিছু লোককে মেরে ফেললে বিক্ষোভ এমনিতেই দমন হয়ে যাবে। বিমানবাহিনীকে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর কথাও তিনি বলেন। এমন পরিস্থিতিতে বৈঠকে উপস্থিত বিমানবাহিনী প্রধান তারেক সিদ্দিকীর ওপর ভীষণ রেগে যান এবং প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, এই লোকটিই আপনাকে ডুবিয়েছে এবং আরও ডোবাবে। ঠিক এ সময় একজন অপরিচিত ব্যক্তি (যাকে ডিউটিরত এসএসএফ সদস্যরা চেনেন না) গণভবনে প্রবেশ করলে শেখ হাসিনা সভা শেষ করে দেন। রাত ১২টা ৪০ মিনিটে তিন বাহিনীপ্রধান গণভবন ত্যাগ করেন। রাতে গণভবনে পুলিশের আইজি আবদুল্লাহ আল মামুন এবং এয়ার ভাইস মার্শাল জামালউদ্দিনও ছিলেন।
৫ আগস্ট সকাল ৯টায় তিন বাহিনীপ্রধান আবার গণভবনে আসেন। এ সময় পুলিশের আইজি এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুবুর রহমানও গণভবনে ছিলেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী পুলিশের আইজি আবদুল্লাহ আল মামুনকে দেখিয়ে বলেন, ওরা (পুলিশ) ভালো কাজ করছে। সেনাবাহিনী পারবে না কেন?
এ সময় পুলিশের আইজি বলেন, পরিস্থিতি যে পর্যায়ে গেছে, তাতে পুলিশের পক্ষেও আর বেশি সময় এ রকম কঠোর অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের আর কিছু করার সামর্থ্য নেই। গোলাবারুদ আর অবশিষ্ট নেই। ফোর্সও টায়ার্ড হয়ে পড়েছে।
এদিকে সামরিক কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীকে আবারও ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী রেগে গিয়ে বলেন, তাহলে তোমরা আমাকে গুলি করে মেরে ফেল এবং গণভবনে কবর দিয়ে দাও। সামরিক কর্মকর্তারা শেখ রেহানাকে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগে রাজি করাতে অনুরোধ করেন। তারা এ কথাও বলেন যে, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ডাকে 'লংমার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচির কারণে গণভবন অভিমুখে ঢাকার চারপাশ থেকে মিছিল আসছে। শেখ রেহানা প্রধানমন্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা চালান। একপর্যায়ে বড় বোন শেখ হাসিনার পা জড়িয়ে ধরেন রেহানা। কিন্তু শেখ হাসিনা রাজি হচ্ছিলেন না। পরে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে কথা বলেন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা। জয়কে বলা হয়, প্রাণে বাঁচাতে হলে তার মাকে পদত্যাগ করা ছাড়া উপায় নেই। টাইম একটা ফ্যাক্টর। এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জয় পরিস্থিতি জানার পর মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। অবশেষে জয়ের কথায় ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা। তিনি টেলিভিশনে প্রচারের জন্য একটি ভাষণ রেকর্ড করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে সামরিক কর্মকর্তারা অপারগতা প্রকাশ করেন। এ সময় তারা প্রধানমন্ত্রীকে ব্যাগ গোছাতে ৪৫ মিনিটের সময় দেন। কারণ গণভবন অভিমুখে লাখ লাখ ছাত্র-জনতার মিছিল ৪৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবে। ছাত্র- জনতার এই স্রোত ছিল ৩৬ দিনের অভাবনীয় আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ- চব্বিশের বিপ্লব, গণঅভ্যুত্থান।
শেখ হাসিনা কখন পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেছেন এবং কখন হেলিকপ্টারে উঠেছেন সেটি কেবলমাত্র জানতেন স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স, প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট এবং সেনা সদরের কিছু ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা। পুরো বিষয়টি করা হয়েছিল বেশ গোপনে। সোমবার বেলা ১১টার মধ্যেই শেখ হাসিনা গণভবন ছেড়ে যান।
বিভিন্ন সুত্র ও আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপিত তথ্য মতে, শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি খুব গোপনীয়তার সঙ্গে করা হয়। ভারতীয় নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সমন্বয় করে ৪ আগস্টের মধ্যেই পরিকল্পনাটি তৈরি করেন। পরিকল্পনার সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন এসএসএফের ডিজি মেজর জেনারেল একেএম নাজমুল হাসান এবং সেনাবাহিনীর কিউএমজি লে. জেনারেল মুজিব।
গণভবনে দুপুরের খাবার রান্না করা ছিল। কিন্তু খাওয়ার সময়ও ছিল না। বিমানবাহিনীর ‘সি-১৩০ জে’ বিমানে করে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছে। এ সময় তিনি ১৪টি স্যুটকেস সঙ্গে করে নিয়ে যান এবং স্যুটকেসগুলো ঠিকঠাকভাবে বিমানে উঠেছে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হন। শেখ হাসিনার সঙ্গে বিমানে করে আরও পালিয়েছেন তার বোন শেখ রেহানা, জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকী ও তার স্ত্রী এবং একটি শিশু মেয়ে।
গণভবনে দুপুরের খাবার রান্না করা ছিল। কিন্তু খাওয়ার সময়ও ছিল না। বিমানবাহিনীর ‘সি-১৩০ জে’ বিমানে করে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছে। এ সময় তিনি ১৪টি স্যুটকেস সঙ্গে করে নিয়ে যান এবং স্যুটকেসগুলো ঠিকঠাকভাবে বিমানে উঠেছে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হন। শেখ হাসিনার সঙ্গে বিমানে করে আরও পালিয়েছেন তার বোন শেখ রেহানা, জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকী ও তার স্ত্রী এবং একটি শিশু মেয়ে। এ সময় শেখ হাসিনা কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।
কুর্মিটোলা পৌঁছার ১০ মিনিটের মধ্যেই শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও তারেক সিদ্দিকীকে নিয়ে বিমানটি উড্ডয়ন করে। এ সময় সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সব ধরনের বিমানের ওঠানামা বন্ধ করে দেয়। ‘সি-১৩০ জে’ বিমানটি ট্রান্সপন্ডার বন্ধ করে উড্ডয়ন করে, যাতে রাডারের সঙ্গে যোগাযোগ সংযোগ না হয়। সাধারণত বিমান উড্ডয়ন করে নর্থবেঙ্গল হয়ে ঘুরে যায়। কিন্তু এ বিমানটি আকাশে উঠেই নর্থবেঙ্গলে না গিয়ে ত্রিপুরার (আগরতলা) দিকে চলে যায়, যাতে খুব অল্প সময়ে সীমান্ত পার হতে পারে। এরই মধ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ক্লিয়ারেন্স পেয়ে বিমানটি সরাসরি দিল্লি চলে যায় এবং নামে দিল্লির উপকণ্ঠে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদের হিন্দন বিমানঘাঁটিতে। সেখানে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান। জানা গেছে, হাসিনা সেখানেও অজিত দোভালকে ঢাকায় আক্রমণ করতে বলেন।